রাষ্ট্র বনাম সন্ত্রাসবাদ। প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে জঙ্গলমহলে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা। ছবি: রামপ্রসাদ শ।
জঙ্গলমহল খুবই দরিদ্র অঞ্চল। আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে চাষযোগ্য জমি হল প্রধান সম্পদ। জঙ্গলমহলে চাষের জমির অভাব। জমি বলতে এখানে কাঁকুরে মাটি, যার অনেকটাই জুড়ে আছে বনাঞ্চল। কষ্ট করে যেটুকু জমিকে চাষের যোগ্য করা হয়েছে, সেও অনুর্বর। জলের অভাব, তাই বেশির ভাগ জমিতে একটাই চাষ হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম হল কাঁসাই নদীর দু’পাশের জমিগুলি। জঙ্গলমহলে মাথাপিছু উৎপাদন তাই অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কম।
কেন্দ্রীয় সরকারের ১৯৯৯ সালের সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশে যখন মোট ২৭ শতাংশ লোক দারিদ্রসীমার নীচে, তখন আদিবাসীদের ৪৬ শতাংশ দারিদ্রসীমার নীচে। আবার, ২০০৫ সালে দেখা গেল, গোটা দেশে ১০০০ জনের মধ্যে ৫০ জনের অবস্থা সচ্ছল, কিন্তু আদিবাসীদের মধ্যে ভাল অবস্থায় মাত্র ১৪ জন। একটি বাইসাইকেলও নেই, এমন বাড়ি আমাদের দেশে শতকরা ১৮টি, আদিবাসীদের মধ্যে শতকরা ৩৭টি। জঙ্গলমহলের জন্য আলাদা করে সংগ্রহ করা তথ্য আমি পাইনি, কিন্তু এখানেও যে একই ছবি দেখা যাবে তাতে সন্দেহ নেই। এখানেও যাঁরা আদিবাসী নন, যেমন মাহাতোরা তাঁদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাল। আদিবাসীদের মধ্যেও সবার অবস্থা এক নয়। লোধা বা শবর সম্প্রদায় সবচেয়ে অনগ্রসর। বেশির ভাগ মানুষ যেহেতু গরিব, তাই দোকানপাটও কম। চায়ের দোকান, মুদির দোকান, সাইকেল মেরামতের দোকান অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কম।
তবে, জঙ্গলমহলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মতে, অনাহারে কেউ নেই। দু’বেলা খাবার সবারই জুটে যায়। পিঁপড়ের ডিম খেয়ে কাউকে বাঁচতে হয় না। বস্তুত, পিঁপড়ের ডিম একটি ডেলিকেসি জামাইষষ্ঠীর দিন চাইলেও পাওয়া যায় না। দু’টাকা কিলো দরে চাল পাওয়াতে গরিব মানুষ উপকৃত হয়েছেন।
আদিবাসী ও অন্যদের মধ্যে এই ব্যবধান কি কোনও দিন কমবে? বিনপুর-জামবনির অবস্থা কি কখনও কাঁথি-রামপুর অথবা তমলুক-ঘাটালের মতো হবে? আমার মনে হয় না। তার প্রধান কারণ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিষেবার অভাব। কেন্দ্রীয় সরকারের সমীক্ষাতেই দেখা যাচ্ছে, জন্মের এক বছরের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার আদিবাসী ও অন্যদের বেলায় একই। কিন্তু জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে মৃত্যু-হার আদিবাসীদের বেলায় অনেক বেশি। কোনও টিকা নেয়নি, এ রকম শিশুর সংখ্যা দেশে শতকরা পাঁচ, আদিবাসীদের বেলায় শতকরা ১১। সরকারি বেসরকারি যে-সব পরিষেবা শিশুদের বাঁচিয়ে রাখে, সুস্থ রাখে, সেগুলি আদিবাসী এলাকায় নেই বললেই চলে। সেই জন্যই শিশুদের অন্তত আইসিডিএস সেন্টার পর্যন্ত টেনে নিয়ে আসা দরকার। শিক্ষার সমস্যাও একই রকমের। সাক্ষরতার হারে আদিবাসী ও অন্যদের মধ্যে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ তফাত। ১০০টি আদিবাসী শিশু প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলে তাদের মধ্যে মাত্র ১৪ জন দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। আশির দশকে লোধাদের মধ্যে দু’জন গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। সেই সংখ্যা বেড়েছে বলে শুনিনি।
বেলপাহাড়ি ব্লকে এই সমস্যা বেশি। গ্রামগুলি ছোট, ১৫ থেকে ২০ ঘরের। বেশ কিছু গ্রাম গভীর জঙ্গলে। ছড়ানো-ছিটোনো গ্রামগুলিতে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব হয় না। মানুষ সাধারণত এই ব্যবস্থা ছেড়ে শহরাঞ্চলে চলে যান। আদিবাসীরা সেটা করতে চান না। ভারতে এখন শতকরা ৩০ জন থাকেন শহরে, আদিবাসীদের মধ্যে শতকরা মাত্র ১০ জন। অক্ষমতাই হোক বা অনীহা, আদিবাসীরা যে-কোনও মূল্যে নিজের গ্রামেই থেকে যেতে চান। যেহেতু তাঁদের গ্রামে বারো ক্লাস পাশের কোনও মূল্য নেই, ছেলেমেয়েরা তাই স্কুলের পড়া শেষ করে না। আর্থিক সচ্ছলতা বিসর্জন দিয়েও তাঁরা নিরিবিলিতে, শান্তিতে থাকতে চান। মাওবাদীরা এটা বোঝে, তাই ঠিক এই স্বপ্নই দেখায়।
দণ্ডকারণ্যে, অবুজমাঢ়ে মাওবাদী এলাকায় আদিবাসীরা কেমন আছেন? বহিরাগতদের ‘উপদ্রব’ এড়াতে তাঁরা কতটা দারিদ্র মেনে নিয়েছেন? কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। যাঁরাই ওখানে যাওয়ার অনুমতি পান, মুগ্ধ নয়নে মাওবাদীদের দেখে ফিরে আসেন। তাদের সাহস, নিষ্ঠা, মেয়েদের সমান অধিকার, খোলা মাঠে রাত্রিবাস, নিয়মিত বিবিসি-র সংবাদ শোনা, স্যানিটেশন ইত্যাদি। সাধারণ মানুষ কেমন আছেন, সে কথা কেউ লেখেননি। তবে, মাওবাদীদেরও টাকার দরকার। তা পাওয়া যায় বাইরের লোকের কাছে। নিজেদের স্বার্থে তাঁরাই এক দিন বাইরের লোক ঢোকাবেন।
ভাল-মন্দের প্রশ্নে না গিয়ে এটুকু বলা যায় যে, দ্রুত উন্নয়নের মানে উপার্জন বৃদ্ধির প্রলোভন এখানে কাজ করবে না। জঙ্গলমহলের উন্নয়নে অন্য মডেল ব্যবহার করতে হবে। প্রশাসনের তরফে সবচেয়ে বেশি যা দরকার, তা হল, আদিবাসীদের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া, সম্মান দেওয়া এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া।
জেলা প্রশাসন ও পঞ্চায়েত কাজটা ধরেছেন ঠিক। এ বার আদিবাসীরা কী চান, কী চান না, সেটা বুঝে, তাঁদের মতামতকে সম্মান দিয়ে, যথেষ্ট সহানুভূতির সঙ্গে কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ওই কাজ সম্পন্ন করতে প্রয়োজন হবে স্থানীয় মানুষের, বিশেষ করে আদিবাসীদের সক্রিয় সহযোগিতা। কিছু ভাল স্বনির্ভর গোষ্ঠী বেছে নিয়ে তাদের একটু সাহায্য করলে সাধারণ মানুষের যোগদান সম্ভব হতে পারে। সেই চেষ্টা করতে হবে।
অনুন্নত অঞ্চলে সাধারণ মানুষের সাহায্য পেতে মাওবাদীদের সুবিধা হয়। কিন্তু এই সাহায্য ছাড়া তারা কোথাও ঢুকতে পারে না বা থেকে যেতে পারে না, তা নয়। অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের প্রয়োজনে তাদের ডেকে নিয়ে যায়। আমাদের রাজ্যে এমন কোনও দল নেই, যারা নকশালদের বা মাওবাদীদের সাহায্য নেয়নি। অন্য রাজ্যেও একই হাল। এই রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবর্তন লালগড়ে মাওবাদীদের কাজে লেগেছে। আবার যদি পালাবদল হয়, আবার ডাক পড়বে আকাশ-বিকাশদের।
ডাক পড়লেই কি তারা আসতে পারবে? সর্বভারতীয় স্তরে তাদের অবস্থা ভাল নয়। গণপতি এখনও ধরা পড়েননি, কিন্তু আজাদ, কিষেণজি কেউই আর নেই। গুডসা উসেন্দি দলত্যাগ করেছেন। একাধিক পলিটবুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ধরা পড়েছেন। খোদ বাস্তারেই নীচের স্তরের কর্মীদের আত্মসমর্পণের হার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর হামলার সংখ্যা কমেছে। নিরাপত্তারক্ষীদের মৃত্যুর হারও কমেছে। যদিও হিসেব মতো ৮২টি জেলায় মাওবাদীরা সক্রিয়, হামলার ৮০ শতাংশ হচ্ছে ৩০টি জেলায়। অন্ধ্রপ্রদেশে মাওবাদীরা এখন দু’টি জেলায় সীমিত। ঝাড়খণ্ডেও প্রশাসন সাফল্য পেয়েছে। ওড়িশায় সব্যসাচী পন্ডা আগেই দল ছেড়েছিলেন, এখন তিনিও ধরা পড়েছেন। ২০১৩ সালে প্রকাশিত সেন্ট্রাল কমিটির বিবৃতিতে এই কথা স্বীকার করা হয়েছে। কমিটি স্বীকার করেছে যে দল এখন দুর্বল। ২০০৯ সালে অপারেশন গ্রিন হান্ট শুরু করার সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পালানিয়াপ্পন চিদম্বরম বলেছিলেন, দু’-তিন বছরে এই সমস্যা মিটিয়ে দেবেন। তিন বছরে না হলেও পাঁচ বছরে কি সমস্যা মেটার পথে? বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞরা তা-ই মনে করেন। কিন্তু কয়েক জনের ধারণা, এ হল ‘ট্যাক্টিক্যাল রিট্রিট’। সময় মতো ওরা আবার হানা দেবে।
ইদানীং কালের দু’টি ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ। অন্ধ্রপ্রদেশে মাওবাদীরা গণ-আদালত বসিয়ে দু’জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। স্থানীয় মানুষের আপত্তি ছিল, কিন্তু মাওবাদীরা তাঁদের কথা শোনেনি। প্রতিবাদে মানুষ তিন জন মাওবাদীকে পিটিয়ে মারেন। ওড়িশায় অনুরূপ ঘটনায় স্থানীয় মানুষের প্রতিরোধে মাওবাদীরা এক গ্রামবাসীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েও তা ফিরিয়ে নেয়। লালগড়ে প্রায় বিনা প্রতিরোধে ৪০০-র উপর মানুষকে মেরেছিল মাওবাদীরা। তখন তাদের দিকের পাল্লা ভারী ছিল, এখন আর নেই।
এই রাজ্যে আসার আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার সাধ্য থাকলেও মাওবাদীদের কাছে সাড়া দেওয়ার কোনও কারণ আছে কি? মাওবাদীদের কাছে পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্ব কী? উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য পশ্চিমবঙ্গে একটি ঘাঁটি হয়তো দরকার। নাগাল্যান্ডের উগ্রপন্থীদের সঙ্গে মাওবাদীদের খানিকটা যোগাযোগ ছিল। জঙ্গিরা নাগাল্যান্ড থেকে এখানে এসেছে প্রশিক্ষণ নিতে, কিছু বন্দুক গোলাগুলি এসেছে। কিন্তু এই যোগাযোগ গভীর কিছু নয়। নেপালের মাওবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক কোনও দিনই ভাল নয়, তাই সেটাও কারণ হতে পারে না। তা ছাড়া, কলকাতায় মাওবাদীদের একটা বেস চির কালই আছে। আমার মনে হয়, লালগড়ে মাওবাদীদের অভিযান ছিল আকস্মিক এবং সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যহীন। যে সব সাংবাদিক দু’বছর লালগড় চষে বেড়িয়েছেন, তাঁদের কথায়, স্কোয়াড মেম্বারদের মুখগুলি দেখে মনে হত, হয় তারা কোনও ব্যক্তিগত কারণে স্কোয়াডে যোগ দিয়েছেন, না-হয় এসেছেন কিছু পয়সা রোজগার করতে। কারও মুখ দেখে মনে হত না যে সে আদর্শের লড়াইয়ে নেমেছে।
অপারেশন গ্রিন হান্টের স্ট্র্যাটেজি মূলত ঠিকই ছিল। শত্রুকে পরাজিত করতে বিপুল শক্তি প্রয়োগ করা; এক কোম্পানি পুলিশের বদলে তিন কোম্পানি পুলিশ লাগানো; এলাকা থেকে মাওবাদীদের উৎখাত করা, আর তার পর উন্নয়নের কাজে গতি আনা এবং এর জন্য বিশেষ তহবিলের ব্যবস্থা করা। ধরে নেওয়া যায়, কেন্দ্রের নতুন সরকারও এই নীতিই চালিয়ে যাবে। তবে আশঙ্কা, পুলিশি অভিযানের এই সাফল্যের পর উন্নয়নের তহবিলে টান পড়বে না তো? আজ পর্যন্ত ৮২টি জেলায় যে টাকা খরচ হয়েছে, তার ফলাফল জানার জন্য সরকার কোনও সমীক্ষা
করেনি। তা হলে কি আগ্রহ কমে আসছে? তবে সরকার সমীক্ষা না করলেও মাওবাদীরা করেছে। কেন্দ্রীয় কমিটির দলিলে বলা
হয়েছে যে, সরকারি উদ্যোগের ফলে তাদের জনপ্রিয়তা কমেছে।
(চলবে)
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূতপূর্ব মুখ্যসচিব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy