Advertisement
১১ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

কল্পতরু

মুখ্যমন্ত্রী জানাইয়াছেন, যে যাহা চাহিবে, পাইবে। আর চিন্তা নাই। মাঘের শেষে খানিক বৃষ্টিও হইয়া গিয়াছে, বঙ্গেশ্বরীও সুশাসনের মূলমন্ত্রটি আয়ত্ত করিয়া ফেলিয়াছেন। রেশন কার্ড যেমনই হউক, তাহা দেখাইলেই দুই টাকা কিলোগ্রাম দরে চাল-গম মিলিবে, ইহ বাহ্য।

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রী জানাইয়াছেন, যে যাহা চাহিবে, পাইবে। আর চিন্তা নাই। মাঘের শেষে খানিক বৃষ্টিও হইয়া গিয়াছে, বঙ্গেশ্বরীও সুশাসনের মূলমন্ত্রটি আয়ত্ত করিয়া ফেলিয়াছেন। রেশন কার্ড যেমনই হউক, তাহা দেখাইলেই দুই টাকা কিলোগ্রাম দরে চাল-গম মিলিবে, ইহ বাহ্য। মূল কথা হইল, বঙ্গেশ্বরীর খাসতালুকে অধিকারীভেদ উঠিয়া গিয়াছে। যেমন ইচ্ছা, তেমন ভাবে চলিবার স্বাধীনতাটি মুখ্যমন্ত্রীর স্বীকৃতি পাইয়াছে। ফলে, মাধ্যমিকে অবাধ টোকাটুকি করাও যেমন চলে, খোদ আদালতের উদ্বেগ অগ্রাহ্য করিয়া সিন্ডিকেট রাজও তেমনই চলে। ‘প্রত্যেকের চাহিদা’ কথাটি অবশ্য কিঞ্চিৎ অতিকথন— তাহার জন্য শাসক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকিতে হয়। তাহাই জরুরি শর্ত, তাহাই যথেষ্ট শর্ত। সেই শর্তটি পূরণ করিলেই, ব্যস। পুলিশ পিটাইতে চাও? কোনও সমস্যা নাই। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের উপর ছড়ি ঘুরাইতে চাও, অথবা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিস করাইতে চাও? বিলক্ষণ। বন্দরে মাল ওঠানামা বন্ধ করাইয়া দিতে চাও? নির্দ্বিধায়। এই সব চাহিদার তুলনায় রেশনে সস্তা চাল-গমের দাবি তো অতি তুচ্ছ। ভোটের বাজারে সেই আবদারটুকু না রাখিয়া মুখ্যমন্ত্রী পারেন?

মেঠো রাজনীতির ধর্মই হইল মানুষের ক্ষুদ্র স্বার্থ পূরণ করিতে চাওয়া। এইখানেই রাজনীতির সহিত প্রশাসনের মূলগত পার্থক্য। প্রশাসন রাজনীতির সেই না-হক চাওয়ায় লাগাম পরাইবে। কোনটি হয়, আর কোনটি কোনও অবস্থাতেই নয়, তাহা বলিয়া দেওয়াই প্রশাসনের কাজ। সাত-আট কোটি মানুষকে দুই টাকা কেজি দরে চাল-গম দেওয়া যে রাজ্য সরকারের কাজ হইতে পারে না, রাজনীতির ব্যাপারীরা এই কথাটি স্বচ্ছায় না বুঝিলে বুঝাইয়া বলা প্রশাসনের দায়িত্ব। আপত্তির দার্শনিক কারণটি যদি উহ্যও থাকে, বাস্তব সমস্যাগুলি খুলিয়া বলিতে হইবে। প্রশাসনের প্রধান হিসাবে এই দায়িত্বটি প্রাথমিক ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই। দলের কোনও অংশ এমন দাবি করিলে কেন তাহা গ্রহণযোগ্য নহে, তিনিই বলিবেন। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, পাঁচ বৎসর মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিটি দখল করিয়া রাখিবার পরও তিনি মেঠো রাজনীতিকই থাকিয়া গিয়াছেন, প্রশাসক হইয়া উঠিতে পারেন নাই। রাজধর্ম মানে যে কল্পতরু হওয়া নহে, বরং অন্যায্য চাহিদাগুলিকে কঠোর হাতে শাসন করা, বঙ্গেশ্বরী বোঝেন নাই। ফলে, তিনিই রাজ্যের যাবতীয় অন্যায্য দাবির উৎসমুখ। এবং, মেরুদণ্ডহীন প্রশাসনিক যন্ত্র তাঁহার তল্পিবাহক।

বঙ্গেশ্বরী মার্কিন অর্থনীতিবিদ ম্যানসুর ওলসন-এর নাম শুনিয়াছেন, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। ওলসন দুই গোত্রের ডাকাতের কথা বলিয়াছিলেন। প্রথম দল ভ্রাম্যমাণ ডাকাত, আর দ্বিতীয় দল স্থানীয় ডাকাত। প্রথম দল কোনও অঞ্চল লুঠ করিয়া আর সে দিকে ফিরিয়া তাকায় না, নূতনতর গন্তব্যে চলিয়া যায়। দ্বিতীয় দল একটি ভৌগোলিক গণ্ডিতেই আবদ্ধ। তাহাদের বারে বারে একই অঞ্চলে লুঠ করিতে হয়। ওলসন বলিয়াছিলেন, নিজেদের স্বার্থেই দ্বিতীয় গোত্রের ডাকাতরা খানিক ফেলিয়া ছড়াইয়া লুঠ করে, যাহাতে পরের বারের জন্যও কিছু পড়িয়া থাকে। বঙ্গেশ্বরীর দলকে ডাকাতদের সহিত তুলনা করিলে তিনি গোঁসা করিবেন। কিন্তু, তাঁহাদেরও পশ্চিমবঙ্গের বাহিরে যাওয়ার উপায় নাই। অতএব, নিজেদের স্বার্থেই রাজ্যের ভবিষ্যতের সামান্য বাঁচাইয়া রাখা উচিত। তাহাতে পরবর্তী কালে সুবিধা হইবে। তাঁহার কল্পতরু অবতারটি দীর্ঘস্থায়ী হইলে সেই সম্ভাবনা নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE