পাকিস্তান-আমেরিকা সম্পর্ককে মার্কিন রণনীতিবিশারদ ব্রুস রিডেল ‘ডেডলি এমব্রেস’ আখ্যা দিয়াছিলেন। কূটনীতিতে কালান্তক আলিঙ্গন বিরল নহে। অনেক সময়েই একটি রাষ্ট্র বিপজ্জনক জানিয়াও কার্যসিদ্ধির তাগিদে তাহার সঙ্গে হাত মিলাইতে হয় (এই মুহূর্তে যেমন বাশার আল আসাদ), অনেক সময় বিপদ সম্যক না বুঝিয়া হাত মিলাইবার পরে টের পাওয়া যায়, এমন মিত্র শত্রুর অধিক। পাকিস্তানকে ‘বিপজ্জনক’ বলা কি বিধেয়? দিল্লির নীতিকাররা বলিবেন, ‘নিশ্চয়ই’। কিন্তু তাঁহাদের মত নিরপেক্ষ নহে। ইসলামাবাদ বলিবে, ‘কখনও নহে।’ কিন্তু তাহাও আত্মপক্ষ সমর্থন। সত্য প্রায়শই দুই বিপরীত অবস্থানের মধ্যবর্তী। এ ক্ষেত্রে তাহা দুই দিক হইতে মধ্যবর্তী। প্রথমত, পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসাবে বিপজ্জনক না হইতে পারে, কিন্তু মিত্র হিসাবে তাহাকে ব্যবহার করিবার কৌশল সম্পূর্ণ নিরাপদ নহে। দ্বিতীয়ত, ওয়াশিংটন তাহা জানে, কিন্তু বিপদ ঠিক কতখানি ও কেমন, তাহার সম্পূর্ণ ধারণা মার্কিন নীতিকারদের না থাকাই সম্ভব। ইসলামাবাদের মিত্রতা লইয়া প্রশ্ন আছে, তাহা জানিয়াও ওয়াশিংটন অনেক কাল ধরিয়াই তাহার প্রতি হাত বাড়াইতে বাধ্য হইয়া আসিতেছে। কূটনীতি বড় দায়।
এই দায়ে পড়িয়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিদেশ সচিব, প্রতিরক্ষা সচিবের মতো বড়কর্তারা পাকিস্তানের সেনাপ্রধান রাহিল শরিফকে ওয়াশিংটনে পরম আপ্যায়ন করিলেন। তৃতীয় বিশ্বের এক সেনাপতিকে মার্কিন সরকারের এত গুরুত্ব প্রদর্শন বিরল বলিলে কম বলা হয়। শরিফের সহিত বৈঠক সারিয়া মার্কিন সেনেটের একটি কমিটির প্রধান, জন ম্যাকেন বলিয়াছেন, তাঁহার নেতৃত্বে পাক সেনাবাহিনী সন্ত্রাস দমনে দারুণ কাজ করিতেছে। এই প্রশস্তির প্রকৃত কারণ: আফগানিস্তান। বারাক ওবামা সে দেশ হইতে সেনা প্রত্যাহারের সংকল্প করিয়াছেন, কিন্তু পরিস্থিতি সঙ্গিন, সংকল্প রক্ষা দুষ্কর। আফগানিস্তানে উত্তরোত্তর শক্তিবৃদ্ধিরত তালিবানদের মোকাবিলাই হউক, স্থিতি প্রতিষ্ঠায় ‘ভাল তালিবান’দের সাহায্য লওয়াই হউক, কোনও কৌশলই পাকিস্তানের সাহায্য ছাড়া প্রয়োগ করা অসম্ভব। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া আফগানিস্তান ছাড়িবার চেষ্টা এখন ওবামার পক্ষে সম্ভব নয়। পশ্চিম এশিয়ার দুর্বিপাক তাঁহার এই সংকট সহসা বহুগুণ বাড়াইয়া তুলিয়াছে। অতএব, রাহিল শরিফের পরম আদর।
দিল্লি মার্কিন প্রশাসনের এই আচরণ ভাল চোখে দেখিবে না। কিন্তু ইহাই নির্মম সত্য। পাকিস্তানের রাজনীতি ও প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব বিপুল। অধুনা সেই কর্তৃত্ব একটি বিশেষ রূপ ধারণ করিয়াছে, নির্বাচিত সরকারকে গদিতে রাখিয়াই সেনানায়ক কার্যত সরকারের লাগাম আপন হাতে ধরিয়া রাখেন— এই ব্যবস্থাকে ‘সফ্ট ক্যু’ অর্থাৎ পরোক্ষ অভ্যুত্থান নামও দেওয়া হইয়াছে। সুতরাং মার্কিন প্রশাসন আফগানিস্তান তথা বৃহত্তর ভূ-রাজনীতির স্বার্থে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সঙ্গে রাখিতে যত্নবান হইবে। এবং সাফ কথা, তাহারা ভারতের স্বার্থবিরোধী কাজ করিলেও, কাশ্মীর সংকটে ক্রমাগত ইন্ধন জোগাইয়া চলিলেও ওয়াশিংটনের যত্ন বহাল থাকিবে। রাহিল শরিফের সফর উপলক্ষে মুম্বইয়ে ২৬/১১-র সন্ত্রাসের ঘটনায় পাকিস্তানের সেনা এবং আইএসআইয়ের ভূমিকার কথা তুলিলে মার্কিন বিদেশ দফতরের মুখপাত্র কার্যত সেই সত্যটিই জানাইয়া দিয়াছেন। কূটনীতি নামটি বাস্তবিকই অতি উপযুক্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy