এক দশক আগে বিচারপতি নিয়োগের ঘটনা লইয়া অভিযোগ থাকিলে তাহা কেন এক দশক পরে জনসমক্ষে আনিলেন, এই প্রশ্নের সদুত্তর সুপ্রিম কোর্টের ভূতপর্ব বিচারপতি এবং প্রেস কাউন্সিলের কর্ণধার মার্কণ্ডেয় কাটজু দেন নাই। হয়তো সৎ উত্তর নাই বলিয়াই দেন নাই। কিন্তু অভিযোগ বিলম্বিত হইলেও, এমনকী বিশেষ অভিযোগটি যাচাই করিয়া তাহার সত্যাসত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ আর না থাকিলেও, তাহার গুরুত্ব কমে না। তাহার কারণ, বিচারপতি নিয়োগের যে ব্যবস্থাটি এই অভিযোগ এবং তাহার অনুসারী বিতর্কের জন্ম দিয়াছে, সেই ব্যবস্থা এখনও বহাল। বিচারপতিদের একটি ‘কলেজিয়াম’ বা নির্ধারিত গোষ্ঠীই নূতন বিচারপতিদের নিয়োগ করেন এবং কীসের ভিত্তিতে সেই নিয়োগ সম্পন্ন হয়, তাহা বাহিরের কাহাকেও জানাইবার কোনও দায়বদ্ধতা তাঁহাদের থাকে না। এখানেই সমস্যা। বিচারপতিরা অবশ্যই মহামান্য, তাঁহাদের প্রজ্ঞা এবং নিরপেক্ষতা সম্পর্কে কোনও সাধারণ সংশয় পোষণের প্রশ্নই ওঠে না। প্রশ্ন ব্যবস্থাটি সম্পর্কে। গোষ্ঠীবদ্ধ এবং অস্বচ্ছ যে কোনও ব্যবস্থাই অপব্যবহারের সম্ভাবনা থাকে, তেমন অপব্যবহার ঘটিলে তাহা গোপন থাকিয়া যাইবার আশঙ্কা থাকে, ফলে— অপব্যবহার হউক বা না হউক— সন্দেহের বীজ উপ্ত হইতে থাকে। সেই বীজ সর্বদাই উচ্চফলনশীল, স্বচ্ছতা ভিন্ন সেই বিষবৃক্ষ নির্মূল করিবার দ্বিতীয় কোনও উপায় নাই। মার্কণ্ডেয় কাটজুর অভিযোগ যে সন্দেহের জন্ম দিয়াছে, তাহা সত্য হউক বা না হউক, দুর্মর।
সত্তরের দশকে ইন্দিরা গাঁধীর উদ্যোগে বিচারবিভাগের উপর শাসনবিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অবাঞ্ছিত ইতিহাসের চাকা বিপরীতে ঘুরাইতেই নব্বইয়ের দশকে সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায় বর্তমান কলেজিয়াম ব্যবস্থাটির প্রবর্তন ঘটায়। উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। কিন্তু উদ্দেশ্য ও বিধেয় এক নহে। নূতন ব্যবস্থা যত পুরানো হইয়াছে, তাহার বিপদও ততই স্পষ্ট হইয়াছে। প্রয়োজন বিচারপতি নিয়োগের নীতি ও পদ্ধতির সংস্কার। পূর্ববর্তী সরকার এই সংস্কারের উদ্দেশ্যে সংসদে আইন-প্রস্তাব আনিয়াছিল। বর্তমান সরকার হয়তো সেই বিলটি পর্যালোচনা করিতে চাহিবে। কলেজিয়ামের পরিবর্তে বিচারপতি নিয়োগের দায়িত্ব একটি সুগঠিত কমিশনের হাতে তুলিয়া দেওয়াই প্রস্তাবিত বিলটির লক্ষ্য। সেই কমিশনে শাসনবিভাগ এবং বিচারবিভাগের পাশাপাশি অন্য কয়েক জন উপযুক্ত ব্যক্তিকেও সদস্য হিসাবে স্থান দেওয়ার কথা। নীতিগত ভাবে এই পথই সুপথ। ইহাতে সীমিত গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ হইতে সমগ্র আয়োজনটিকে মুক্ত করা সম্ভব, অস্বচ্ছতার আশঙ্কাও কমানো সম্ভব। এই ধরনের কমিশনে সংসদীয় বিরোধী পক্ষের প্রতিনিধিত্ব বিশেষ সহায়ক হইতে পারে। স্বচ্ছতার খাতিরেও, আলোচনাভিত্তিক গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যোন্নতির খাতিরেও।
কিন্তু কলেজিয়ামের স্থলে কমিশন আনিলেই সব সমস্যা মিটিয়া যাইবে, এমন ধারণা যুক্তিসম্মত নহে। যাঁহারা কমিশন চালাইবেন, প্রয়োজন তাঁহাদের সম্পূর্ণ নীতিনিষ্ঠ আচরণ। তাহার পাশাপাশি প্রয়োজন শাসনবিভাগ এবং বিচারবিভাগের কর্ণধারদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা। এই শর্তগুলি পূর্ণ না হইলে কোনও বন্দোবস্তই নিরাপদ থাকে না। লক্ষণীয়, মার্কণ্ডেয় কাটজুর বক্তব্যের সারাৎসার ইহাই যে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এক জন বিচারপতির মেয়াদ বাড়াইবার জন্য ইউপিএ সরকার কলেজিয়ামের উপর চাপ সৃষ্টি করিয়াছিল এবং সফল হইয়াছিল। অর্থাৎ শাসনবিভাগের প্রভুত্ব হইতে বিচারবিভাগকে মুক্ত করিবার জন্য যে আয়োজন, তাহাকেই কাজে লাগাইয়া প্রভুত্ব জারির অভিযোগ। সম্মুখের দ্বার বন্ধ হইলে প্রভুত্ব যদি খিড়কি দিয়া প্রবেশ করে, তাহা দ্বিগুণ ভয়ানক। কিন্তু গৃহরক্ষীরা সজাগ এবং কর্তব্যনিষ্ঠ না হইলে খিড়কি খুলিবার আশঙ্কা, কেন বাধ্যতে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy