দেশের বাইরে ভারতীয়দের রাখা কালো টাকা উদ্ধারের নতুন পরিকল্পনা করেছিল নরেন্দ্র মোদীর সরকার। মে মাসে এ জন্য সংসদে আইন প্রণীত হয়েছিল। লুকনো সম্পদ এবং আয়ের তথ্য জানানোর জন্য তিন মাসের একটি মার্জনা প্রকল্প (ইমিউনিটি স্কিম) ঘোষণা করা হয়েছিল। এই প্রকল্প নিয়ে বেশ জোরজার প্রচারও করো হয়েছে। সেপ্টেম্বরে মেয়াদ ফুরনো অবধি এই প্রকল্পে মাত্র ৬৩৮টি আবেদনে ৪১৪৭ কোটা টাকার হিসেব জমা পড়েছে, যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ— ২৪৪৮ কোটি টাকা— রাজস্ব হিসেবে সরকারি কোষাগারে আসবে। আবেদনপত্র পিছু উদ্ধার হয়েছে গড়পড়তা সাড়ে ছয় কোটি টাকা। স্পষ্টতই, রাঘববোয়ালরা এই প্রকল্পের আকর্ষণে নিজেদের কালো টাকা সাদা করতে উত্সাহিত হননি। এবং সরকারের অনেক প্রত্যাশা থাকলেও শেষ মুহূর্তে এই প্রকল্পের সুযোগ নেওয়ার জন্য কোনও উত্সাহ উদ্দীপনাও দেখা যায়নি।
এই আইন তথা প্রকল্প যে পর্বতের মূষিক প্রসবে পর্যবসিত হবে, সরকারের সমালোচকরা সেটা আগেই বলেছিলেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং তাঁর দফতরের অফিসাররা এই ব্যর্থতাকে বিশেষ পাত্তা দিতে চাননি। তাঁরা হুমকি দিয়েছেন যে, যারা কালো টাকা কবুল করেনি, এ বার তাদের উপর রাজস্ব বিভাগের খাঁড়া নেমে আসবে। কিন্তু এ সব কথাকেও লোকে ফাঁকা আওয়াজ বলেই গণ্য করছে।
প্রথম কথা হল, এমন একটি অকেজো আইন আদৌ করা হল কেন? ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী এবং ভারতীয় জনতা অন্য পার্টির বড় বড় নেতারা দাবি করেছিলেন, ক্ষমতা হাতে পেলে তাঁরা কালো টাকা উদ্ধার করে এনে দেশের প্রত্যেকটি দরিদ্র পরিবারকে পনেরো লক্ষ টাকা করে দেবেন। বাবা রামদেবের মতো মোদীর কোনও কোনও সমর্থক আবার বলেছিলেন, বিজেপি সরকার গড়লে একশো দিনের মধ্যে এই টাকা উদ্ধার করে আনা হবে। স্পষ্টতই, ভোটের আকাশে ফানুস ওড়ানো হয়েছিল।
বিজেপি ক্রমাগত প্রচার করেছিল যে, কংগ্রেস সরকার বিদেশি ব্যাঙ্কে আমানতকারীদের বাঁচাতে চেয়েছিল বলেই তাদের নাম প্রকাশ করেনি। এখন, সেই সব আমানতের খবর উদ্ধার করতে না পেরে বিজেপি সমস্যায় পড়ছে। বিরোধীরা আগে থেকেই বলেছে যে, প্রধানমন্ত্রী ভোটের প্রচারে লম্বাচওড়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। কালো টাকা উদ্ধারের প্রশ্নে সেই সমালোচনা আরও জোরদার হয়েছে। ঘটনা হল, দেশের বাইরে ভারতীয়রা কে কোথায় কত টাকা রেখেছেন, তার হিসেব আগেও কারও জানা ছিল না, এখনও নেই। অনুমানের অবশ্য কমতি নেই।
মোদী নিজেও ২ অক্টোবর তাঁর মন কি বাত নামক বেতারবার্তায় স্বীকার করেছেন, বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকার নির্দিষ্ট হিসেব কারও কাছে নেই। তিনি বলেছেন, ‘কত টাকা লুকিয়ে রাখা আছে, তা কেউ জানে না, আমি জানি না, সরকার জানে না, আপনি জানেন না, আগের সরকারও জানত না। যে যার নিজের অঙ্ক বলে চলে। কিন্তু আমি হিসেবনিকেশের জটিলতায় জড়িয়ে পড়তে চাই না, আমার প্রতিশ্রুতি: কালো টাকার পরিমাণ যা-ই হোক— দু’টাকা, পাঁচ টাকা, এক কোটি টাকা— আমি তা উদ্ধার করে আনব, সেটা আসলে গরিবের প্রাপ্য, তা ফিরিয়ে আনার জন্য আমার চেষ্টার কোনও ঘাটতি থাকবে না।’
কালো টাকার ব্যাপারটা নিয়ে আরও ঝঞ্ঝাট বেধেছে এবিপি নিউজ-এর এক সাক্ষাত্কার বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের একটি মন্তব্যে। তিনি মন্তব্য করেছেন, নির্বাচনী প্রচারে কালো টাকা উদ্ধার নিয়ে যা বলা হয়েছিল, সেটা আসলে ‘জুমলা’, অর্থাত্ আলঙ্কারিক কথা, তাকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া ঠিক নয়।
কালো টাকা উদ্ধারের নতুন আইন ও সংশ্লিষ্ট মার্জনা প্রকল্পটি নিয়ে নানান সমস্যা আছে। প্রথমত, ভারতীয়দের বিধিবহির্ভূত সম্পদ ও আয়ের বেশির ভাগই, হয়তো নব্বই শতাংশই আছে দেশের ভিতরে। অর্থাত্, কালো টাকার সামান্য অংশই নতুন আইনের পরিধিতে আসতে পারে। দ্বিতীয়ত, যে টাকাটা অবৈধ ভাবে বাইরে রাখা হয়, তা-ও সচরাচর খুব বেশি দিন এক জায়গায় থাকে না, হয় খরচ করে দেওয়া হয় অথবা বিভিন্ন কৌশলে, বিশেষত মরিশাসের মতো করমুক্ত অঞ্চল ঘুরিয়ে— ‘রাউন্ড ট্রিপিং’ করিয়ে— সাদা করে নেওয়া হয়। তৃতীয়ত, নতুন আইনটি অনাবাসী ভারতীয় (এনআরআই) বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের (পিআইও) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, এ আইনের আওতায় আছেন কেবল আয়করদাতা ভারতীয় নাগরিকরা। প্রসঙ্গত, আয়কর আইনে বলা আছে যে, কেউ যদি একটি অর্থবর্ষের অর্ধেক, অর্থাত্ ১৮২ দিনের বেশি ভারতে না কাটান, তা হলে তিনি অনাবাসী ভারতীয় হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য হতে পারেন। কালো টাকা উদ্ধারের আইন আসছে, এটা জানার পরে বিদেশে বিধিবহির্ভূত সম্পদ বা আয় আছে, এমন কারও পক্ষে এই আইনের ফাঁক দিয়ে নিজেকে অনাবাসী বলে দেখিয়ে নেওয়া কঠিন ছিল না, অনেকেই যদি সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে থাকেন, অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ভূতপূর্ব অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল বিশ্বজিত্ ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন, কালো টাকা বিষয়ক আইনটি অর্থহীন, কারণ কেউ বিদেশি মুদ্রার অবৈধ কারবার সংক্রান্ত আইন ‘ফেমা’ (১৯৯৯) লঙ্ঘন করলেও এই নতুন আইন তার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে না। অথচ কোনও ভারতীয় অধিবাসীর মালিকানায় বা নিয়ন্ত্রণে থাকা যে কোনও অফিস, এজেন্সি বা শাখার ক্ষেত্রে ফেমা প্রযোজ্য। আইনটির আর একটি খামতি হল, কেউ বিদেশে রাখা বিধিবহির্ভূত সম্পত্তির কথা জানালেও তাকে সেই সম্পত্তি বিদেশি মুদ্রায় দেশে আনতে বাধ্য করা যাবে না। আরও একটা বিষয়ে বিশ্বজিত্বাবু দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। নতুন আইনটি বলবত্ হওয়ার নির্ধারিত তারিখ ছিল ২০১৬’র ১ এপ্রিল। একটি প্রশাসনিকনির্দেশের বলে সেটিকে ২৭৬ দিন এগিয়ে এনে করা হয়েছে এ বছরের ১ জুলাই। এই নির্দেশটি এখনও কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি, কিন্তু তাঁর মতে এটা একেবারেই বেআইনি।
মোদ্দা কথা হল, ভারতে কালো টাকার অতিকায় সমস্যার মোকাবিলায় নতুন আইনটি মোটের উপর অপ্রাসঙ্গিক। মোদী সরকার যাতে বলতে পারে, তারা দেশের বাইরে অবৈধ ভাবে নিয়ে যাওয়া সম্পদ উদ্ধারের চেষ্টা করছে, স্রেফ সেই উদ্দেশ্যেই এই আইন করেছে। অর্থাত্ কালো টাকা উদ্ধার গৌণ, নরেন্দ্র মোদীর মুখরক্ষা করাই এই আইনের আসল লক্ষ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy