অমিত মিত্র হাসিয়া বলিতে পারেন, আমাদের অবস্থা অন্তত গ্রিসের তুলনায় ভাল। দাবিটিকে অমূলক বলা যাইবে না। মিত্রমহাশয়, অন্তত এখনও, যথাকালে ঋণ পরিশোধ করিয়া চলিয়াছেন। গ্রিস তাহাতে অক্ষম। তবে রোগ একই। গ্রিসের সংকটের কারণটি জলবৎ— সে দেশ আয়ের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয় করিয়াছে। পরিণতির কথা ভাবে নাই। ইউরোপের বাজার যখন তেজি ছিল, তখন টাকার কথা ভাবিতে হয় নাই। সরকারও দুই হাতে টাকা উড়াইয়াছে। সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়ের নামে বিপুল খয়রাতি হইয়াছে, কর আদায়ে নজর ফিরাইবার ফুরসতই হয় নাই। হায়! সমাজতন্ত্র নামক খোয়াবি পোলাওটির সুবাস বাস্তবে ফুরাইবেই। বাড়ির নাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাখিলে যেমন ভূমিকম্পে সব পড়িয়া যাওয়াই দস্তুর, তেমনই খয়রাতির শেষে ঋণ শোধ করিবার সময় আসিলে হা়ড়ে কাঁপুনি লাগিবেই। গ্রিস এখন কাঁপিতেছে। সে দেশে অর্থনীতি বলিতে কার্যত কিছু অবশিষ্ট নাই। বিনিয়োগের নামগন্ধ নাই। নব্বই শতাংশ পণ্য আমদানি করিতে হয়। গ্রিস ডুবিয়াছে। ডুবিবার জন্য বিবিধ সাগর হাতের কাছে আছে। কিন্তু, গ্রিস একা ডুবিবে না, তাহার সহিত ইউরোপকেও টানিয়া নামাইতেছে।
অনিশ্চয়তার এই সলিলটি ইউরোপেরও স্বখাত। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্তারা মাঝেমধ্যেই খেদোক্তি করিতেন, দলে বড় বেশি বেনোজল ঢুকিয়া পড়িয়াছে। সেই চোরাস্রোত আটকাইতে না পারিলে কী হয়, তাঁহারা বিলক্ষণ টের পাইয়াছেন। ইউরোপের কর্তারা সম্ভবত অধিকতর মূল্যে একই শিক্ষা গ্রহণ করিতেছেন। গ্রিস নামক দেশটি একেবারে বিশুদ্ধ বেনোজল। ইউরো অঞ্চলে প্রবেশ করিবার যোগ্যতা তাহার কখনও ছিল না। গ্রিসের অর্থনীতির সেই জোর ছিল না যাহাতে অভিন্ন ইউরোর বাজারে টিকিয়া থাকা যায়। কিন্তু, দেড় দশক পূর্বে তখন ইউরোপের কর্তারা সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে অবগাহন করিতেছিলেন। ইউরোপব্যাপী সমাজতন্ত্রের স্বপ্নের সম্মুখে গ্রিসের খামতিগুলি তখন তুচ্ছ বোধ হইয়াছিল। ফলে, নিয়ম শিথিল করিয়া, পরিসংখ্যান ভাঁড়াইয়া গ্রিসকে ইউরো অঞ্চলের হেঁসেলে ঢুকাইয়া লওয়া হইয়াছিল। তাহার পরেও ইউরোপের নেতারা গ্রিসের অবিমৃশ্যকারী রাজনীতি দেখিয়াও না দেখিয়া ছিলেন। সেই পাপের ফল এখন ভুগিতে হইতেছে। এই পাপ ইউরোপের ঝোলাওয়ালা অর্থনীতির। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন ব্যয়ের নিদান মানিয়া নিলে এই অবস্থাই হয়। বস্তুত, এই বিপর্যয়ের বাজারে গ্রিসকে দেওয়ার মতো একটি সম্পদ ভারতের রহিয়াছে। সিপ্রাস যদি পদত্যাগ করেন, সনিয়া গাঁধী বিলক্ষণ গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী হইতে পারেন। তিনি ভারতকে যে রাস্তায় হাঁটাইতেছিলেন, গ্রিস সেই পথেরই পথিক।
রাজনীতিকদের দোষ, অবশ্যই। দিশাহীন অর্থনীতিই আজ গ্রিসকে এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন করিয়াছে। কিন্তু গভীরতর অর্থে, দোষ নাগরিকদের। যাঁহারা এমন দিশাহীনতাকে প্রশ্রয় দেন, এই রাজনীতিকদের ক্ষমতায় আনেন। আলেক্সিস সিপ্রাস এই জানুয়ারিতে ভোটে জিতিয়া গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী হইয়াছেন। তিনি ঋণ পরিশোধ না করিবার স্লোগানেই জয়ী। দেশের জনতা তাঁহার নিকট জানিতে চাহেন নাই, গ্রিসের অর্থনীতি বাঁচিয়া উঠিবে কী উপায়ে? এই দেশে কেহ বিনিয়োগ করিবেন কেন? বরং, রবিবারের গণভোটে বুঝাইয়া দিয়াছেন, সিপ্রাসই তাঁহাদের যোগ্য নেতা। প্রায় দুই-তৃতীয়ংশ মানুষ রায় দিয়াছেন, তাঁহারা আর কঠোর আর্থিক নীতি মানিতে রাজি নহেন। অর্থাৎ, তাঁহারা ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করিবেন না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নিশ্চয়ই মিল খুঁজিয়া পাইবেন। তাঁহারাও সেই নেত্রীকেই সমর্থন করিতেছেন, যিনি ঋণের টাকা ফিরাইতে নারাজ। যিনি কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণ মকুব করিয়া দেওয়ার খোয়াবেই বাঁচেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy