রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের তিন মাস পর তাইল্যান্ডের সেনাধ্যক্ষ জেনারেল প্রায়ুথ ওন-চা সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হইয়াছেন। বস্তুত তিনি নিজেই নিজেকে নিযুক্ত করিয়াছেন। তাহার আগে তিনি নির্বাচিত জাতীয় সরকারকে গায়ের জোরে গদিচ্যুত করেন, পার্লামেন্ট ভাঙিয়া দিয়া বশংবদদের মনোনীত করিয়া একটি পুতুল পার্লামেন্ট নিয়োগ করেন এবং তাহার দ্বারা সর্বসম্মতিক্রমে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাঁহার এই নিয়োগ তাইল্যান্ডের প্রথা অনুযায়ী রাজা ভূমিবল অতুল্যতেজ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার কথা। ৮৬ বছর বয়সি রাজা সশরীরে ফৌজি প্রধানমন্ত্রীকে আশীর্বাদ করিতে পারেন নাই, তাই তাঁহার একটি বৃহত্ ছবি টাঙাইয়া তাহার সামনে আভূমি প্রণত হইয়া জেনারেল প্রায়ুথ তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্বে রাজকীয় সিলমোহর সংগ্রহ করিয়াছেন। অতঃপর জেনারেল প্রায়ুথ ‘গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা’র জন্য দেশবাসীকে কর্তৃপক্ষের সহিত সহযোগিতা করিতে আর্জি জানাইয়াছেন। গণতন্ত্রই বটে।
একটি নির্বাচিত সরকারকে গদিচ্যুত করিয়া ক্ষমতা দখলের অজুহাত হিসাবে জঙ্গি জেনারেল যে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক নৈরাজ্যের কথা বলিয়াছিলেন, তাহা নিশ্চয়ই মিথ্যা বলা চলে না। তাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাবাত্রার ইস্তফার দাবিতে বিরোধী পক্ষের সমর্থকরা মাসের পর মাস রাজধানী ব্যাংককের সমস্ত প্রধান সড়ক, সরকারি দফতর অবরুদ্ধ রাখিয়াছিলেন। প্রশাসন কোনও কাজ করিতে পারিতেছিল না। উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনাধ্যক্ষ এই সুযোগই কাজে লাগাইয়াছেন, যাহার ফলে দীর্ঘ বাইশ বত্সর পরে তাইল্যান্ড ফৌজি শাহিতে ফিরিয়াছে। লক্ষণীয়, পাকিস্তানে এই মুহূর্তে প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করিতেছে। ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের স্বেচ্ছাসেবক এবং মৌলবি তাহির-আল-কাদরির অনুগামীরা ইসলামাবাদ অভিমুখে অভিযানের শেষে রাজধানী অবরুদ্ধ করিয়াছেন। তাঁহারা পার্লামেন্ট এবং অন্যান্য সরকারি প্রশাসনিক ভবনও অবরোধ করিয়াছেন। তাঁহাদের দাবি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ইস্তফা, যিনি মাত্র কিছু কাল হইল নির্বাচনে গরিষ্ঠতা হাসিল করিয়া ক্ষমতাসীন। ইমরান কিংবা কাদরি পরবর্তী জনাদেশ অবধি অপেক্ষা করিতে নারাজ। তাই গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত একটি সরকারকে বরখাস্ত করিয়া নূতন নির্বাচনের দাবিদার। বিরোধীদের এই অবরোধ পাকিস্তানের রাজনীতিকে জটিল করিয়াছে, সেনাবাহিনী আপসে বিরোধ মিটাইতে সরকারকে চাপ দিতেছে। নওয়াজ শরিফও ইসলামাবাদ সহ অন্যান্য বড় শহরের নিরাপত্তার ভার সেনার হাতে তুলিয়া দিয়াছেন। অশনি সংকেত।
পাকিস্তান তাহার জন্মলগ্ন হইতে অদ্যাবধি প্রায় অর্ধেক আয়ু জঙ্গি শাহির অধীনে কাটাইয়াছে। পাক জেনারেলরা বরাবরই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করিয়াছেন, কখনও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে অপসারিত করিয়া নিজেরা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হইয়া বসিয়াছেন। তাইল্যান্ডের মতো পাকিস্তানেও গণতন্ত্র অপেক্ষাকৃত নবীন, অপরিণত, পরীক্ষামূলক। এখনও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি সেখানে দৃঢ়মূল নয়, সেনাবাহিনী ছাউনির ভিতরে থাকিতে অভ্যস্ত নয়, গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতিও জনপ্রিয় হয় নাই। জেনারেলরা এই সব দেশে সর্বদাই ক্ষমতাদখলের সুযোগে থাকেন। অচলাবস্থা প্রলম্বিত হইলেই সামরিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। গণতন্ত্রের দুর্বলতাই উর্দিকে ডাকিয়া আনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy