Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র

রাজতন্ত্রের কালে দুই-একজন ব্যতিক্রমী, উদারমনস্ক ও মানবিক রাজাকে বাদ দিলে অধিকাংশ রাজাই জনসাধারণ হইতে বিচ্ছিন্ন থাকিতেন। জনসাধারণকে বস্তুত তাঁহারা ভয় করিয়া চলিতেন। এই ভয়, ক্ষতি বা বিপদের শঙ্কা তাঁহাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে অগ্রাধিকার দিত, তাঁহারা প্রহরীবেষ্টিত হইয়া চলাফেরা করিতে অভ্যস্ত হইতেন।

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

রাজতন্ত্রের কালে দুই-একজন ব্যতিক্রমী, উদারমনস্ক ও মানবিক রাজাকে বাদ দিলে অধিকাংশ রাজাই জনসাধারণ হইতে বিচ্ছিন্ন থাকিতেন। জনসাধারণকে বস্তুত তাঁহারা ভয় করিয়া চলিতেন। এই ভয়, ক্ষতি বা বিপদের শঙ্কা তাঁহাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে অগ্রাধিকার দিত, তাঁহারা প্রহরীবেষ্টিত হইয়া চলাফেরা করিতে অভ্যস্ত হইতেন। গণতান্ত্রিক শাসকদের অর্থাত্‌ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তেমন প্রহরা বা নিরাপত্তা প্রয়োজন হইবে কেন? সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি এই প্রশ্নটিই উত্থাপন করিয়াছে। শীর্ষ আদালতের বক্তব্য জনসাধারণই তো জনপ্রতিনিধিদের নিরাপত্তার রক্ষাকবচ, তাঁহাদের আবার আলাদা করিয়া রক্ষীবেষ্টিত থাকিতে হইবে কেন? প্রশ্নটি নূতন উঠিল না। কিন্তু ঘটনা ইহাই যে, নিরাপত্তার মাত্রাএ এখন রাজপুরুষদের (এবং রাজমহিলাদেরও) মর্যাদা বা গুরুত্বের প্রতীক এবং মাপকাঠি হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

এমনও দেখা গিয়াছে যে, বহুসংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী না পাওয়ায় জনপ্রতিনিধিরা ক্ষুব্ধ হইতেছেন, সরকার, এমনকী আদালতে নালিশও করিতেছেন। উত্তরপ্রদেশের বিধান পরিষদের বিরোধী নেতা নাসিমুদ্দিন সিদ্দিকির ‘জেড-ক্যাটেগরি’ নিরাপত্তা পাওয়া, না-পাওয়ার বিতর্কই সর্বোচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক মন্তব্যের উপলক্ষ। তবে কি জনবিচ্ছিন্নতা, আমজনতা হইতে নিরাপদ দূরত্ব ও নিরাপত্তায় অধিষ্ঠানই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পছন্দসই? সামনে লাল-বাতি লাগানো এবং ভেঁপু-বাজানো পুলিশ এসকর্ট এবং পিছনেও উর্দিধারী নিরাপত্তারক্ষী লইয়া যাতায়াত করিতে অভ্যস্ত এই জনপ্রতিনিধিরা এক বারও ভাবিয়া দেখেন না, তাঁহাদের ‘নিরাপত্তা’র আবদার মিটাইতে সরকারি কোষাগারে গচ্ছিত জনসাধারণের দেওয়া করের কী বিপুল অপচয় হইতেছে। কোনও কোনও সময়ে কিছু নেতা বা মন্ত্রীর ক্ষেত্রে অথবা দেশে বা রাজ্যে বিশেষ পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই বিশেষ নিরাপত্তার প্রয়োজন হইয়া থাকে, কিন্তু তাহা ব্যতিক্রম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, অনুমান করা যায়, সুরক্ষা নয়, গুরুত্বই প্রকৃত লক্ষ্য। সেপাই-সান্ত্রি যত বেশি, লালবাতি যত চড়া, ভেঁপু যত উচ্চরব, রাজনীতিক তত ওজনদার। এই মানসিকতা কিন্তু কোনও মতেই গণতান্ত্রিক নয়, নেহাতই সামন্ততান্ত্রিক।

এই মানসিকতাই উত্তরবঙ্গের বন্ধ চা-বাগানের তিন শত নিরন্ন শ্রমজীবীর হাতে পাঁচ কেজি করিয়া চাল তুলিয়া দিতে দুই জন মন্ত্রী ও কয়েক গণ্ডা আধিকারিককে লইয়া ছাব্বিশটি মোটরগাড়ির কনভয় চালাইবার উত্‌কট আচরণে নিহিত থাকে। এতগুলি গাড়ি কয়েকশো কিলোমিটার ধরিয়া যে বহুমূল্য জ্বালানি অপচয় করিল, স্থানীয় বিডিও মারফত চাল বণ্টন করিলে তাহার প্রয়োজন হইত না, উপরন্তু আরও অনেক বেশি পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী ওই অর্থে বুভুক্ষুদের কাছে পৌঁছানো যাইত। কিন্তু তাহাতে ‘প্রজাদের জন্য ডোল-কম্বল বিতরণ করিতেছি’, এই রাজতন্ত্রী দেখনদারির সুযোগটি মাঠে মারা যাইত। প্রহরীবেষ্টিত রাজা বা রাজপুরুষরা লালবাতি জ্বালাইয়া ভেঁপু বাজাইয়া জনসাধারণকে তাঁহাদের যাত্রাপথ হইতে নিরাপত্তার অজুহাতে ধাক্কা দিয়া সরাইয়া দিবেন কিংবা দরিদ্রের পর্ণকুটিরে পদধূলি দিবার সাড়ম্বর আয়োজনে কোষাগারের বিপুল অপচয় করিবেন ইহা গণতন্ত্র নয়। অথচ গণতন্ত্রের নামে মধ্যযুগীয় ও ন্যক্কারজনক রাজতন্ত্রী আত্মপ্রচারই অব্যাহত। ‘রাজনৈতিক ভাবে সচেতন’ পশ্চিমবঙ্গেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE