ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রনায়ক উগো চাভেস নিজেকে ‘আজীবন প্রেসিডেন্ট’ দেখিতে চাহিয়া সংবিধান সংশোধন করিয়াছিলেন। চাভেস আজ নাই। কিন্তু তাঁহার অনুরূপ রাজনীতিকরা দেশে দেশে রহিয়াছেন, আপন মহিমার অমরত্ব সম্পর্কে যাঁহাদের বিভ্রম দুর্মর। এই তালিকায় আছেন ভারতের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে, যিনি আরও এক বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ব্যাকুলতায় মেয়াদ ফুরাইবার আগেই নির্বাচনের তোড়জোড় করিতেছেন। আর আছেন ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন, রাশিয়ার সেই স্বৈরশাসক, যিনি তিন-তিন বার প্রেসিডেন্ট এবং এক বার প্রধানমন্ত্রী থাকার পরও ২০১৮ সালে পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়ার পরিকল্পনা জানাইয়াছেন। রাশিয়ার সংবিধানকে তিনি এমন ভাবেই সংশোধন করিয়াছেন যে, দুই বার প্রেসিডেন্ট থাকার পরে এক দফায় প্রধানমন্ত্রী থাকিয়া আবার প্রেসিডেন্ট পদে দুই বার দাঁড়ানো যায়। কুনাট্যটি নিখুঁত ভাবেই মঞ্চস্থ হইয়া চলিয়াছে।
নিরঙ্কুশ শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করার দুরাকাঙ্ক্ষা অনেক রাজনীতিকেরই থাকে। চিরকালই ছিল, আজও আছে। আধুনিক গণতন্ত্রেও তাঁহারা দিব্য অন্তর্ঘাত ঘটাইয়া সেই স্বৈরশাসন প্রচলিত রাখিতে পারেন। চাভেস, রাজাপক্ষে কিংবা পুতিন তাহারই জ্বলন্ত প্রমাণ। তিন জনেই গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত শাসক। কিন্তু এক বার নির্বাচিত হওয়ার পর এমন ভাবে তাঁহারা দেশের সংবিধানকে সংশোধন করিয়াছেন যে, তাঁহারাই বার বার শাসক হিসাবে ফিরিয়া আসিতে পারেন। ভ্লাদিমির পুতিন অবশ্য কিঞ্চিৎ দয়া দেখাইয়াছেন। তিনি জানাইয়াছেন, আজীবন অর্থাৎ আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট থাকার কথা তিনি এখনই বিবেচনা করিতেছেন না। তবে ভবিষ্যতের কথা কে বলিতে পারে? বিশেষত তিনি যখন বৃহৎ রুশ জাত্যভিমানের জারসুলভ অহমিকা ফিরাইয়া আনিয়াছেন এবং গণতান্ত্রিক রীতিপদ্ধতি জলাঞ্জলি দিয়া ভিন্ন স্বর ও বিরুদ্ধ মতের কণ্ঠরোধ করিয়া দেশে একটি পুলিশি রাষ্ট্র চালু করিয়াছেন। প্রাক্তন কেজিবি প্রধান পুতিন নিজের ‘বাস্তবের চেয়ে বৃহত্তর’ ভাবমূর্তি দেশবাসীর মনে প্রোথিত করিতে সরকারি প্রচারমাধ্যমকে যথেচ্ছ ব্যবহার করিয়াছেন, পোষা বাঘের সহিত তাঁহার সুবিজ্ঞাপিত লড়াইয়ের চলচ্ছবি ঘরে ঘরে পৌঁছাইয়া দিয়া নিজের ‘অতিমানবিক’ গুণাবলির বিভ্রম রচনা করিয়াছেন। নিরুপায় দেশবাসী কেন এই নব্য জারের প্রতি আনুগত্যে অবিচল, সেটা হয়তো মঞ্চ হইতে তাঁহার পাকাপাকি প্রস্থানের পর তাঁহার উত্তরসূরি ফাঁস করিবেন, যেমনটা স্তালিনের বেলায় নিকিতা ক্রুশ্চভ করিয়াছিলেন।
আপাতত পুতিনের নিরবচ্ছিন্ন স্বৈরতন্ত্র সহ্য করা ছাড়া উপায় নাই। অবশিষ্ট বিশ্বের জন্য ইহার তাৎপর্য হইল, ইউক্রেনের মতো সাবেক উপগ্রহগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার সাম্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টা দেখিয়া যাওয়া। জারের যে-সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার বলশেভিকরাও ছাড়েন নাই, পুতিনই বা ছাড়িবেন কেন? তাই একদা সোভিয়েত স্বৈরাচারে বদ্ধ অধুনা-স্বাধীন দেশগুলি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে না ঝুঁকিয়া যাহাতে পুনরায় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রেই প্রত্যাবর্তন করে, পুতিন তাহা নিশ্চিত করিতে ট্যাংক, সাঁজোয়া বাহিনী, বিমানবহর সবই কবুল করিতেছেন। ক্রাইমিয়াকে ইতিমধ্যেই ইউক্রেন হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লওয়ার পর এখন রুশভাষী অন্যান্য ইউক্রেনীয় জনপদকেও ‘স্বাধীন’ করার অভিযান চলিয়াছে। গণতন্ত্র মারফত স্বৈরাচারকে বৈধ করিয়া লওয়ার অনবদ্য পদ্ধতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy