উদ্দেশ্য হইতে বিধেয়কে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখা যায় না। না ব্যাকরণে, না শাসনতন্ত্রে। গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস আগামী রবিবার যে গণভোট ডাকিয়াছেন, তাহা কি বিধেয়? কী উদ্দেশ্যে তাঁহার এই সিদ্ধান্ত, তাহার উপরে এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করিতেছে। গণভোট বস্তুটি আপাতদৃষ্টিতে অতি উত্কৃষ্ট। তাহার সহিত প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের অঙ্গাঙ্গি যোগাযোগ। নাগরিকরা সরাসরি ভোট দিয়া নীতি নির্ধারণ করিতেছেন— ‘জনগণের দ্বারা’ শাসন চালাইবার এমন প্রশস্ত উপায় আর কী হইতে পারে? ইউরোপীয় গণতন্ত্রের আদিভূমি গ্রিসে গণভোটের মহিমা দ্বিগুণ, কারণ তাহা সহজেই সেই ভূখণ্ডের প্রাচীন নগর-রাষ্ট্রের কথা মনে পড়াইয়া দিতে পারে। রবিবার গ্রিসের নাগরিকরা আড়াই হাজার বছর আগেকার পূর্বসূরিদের কথা স্মরণ করিয়া ভাবিতে পারেন, সেই গণভোট সমানে চলিতেছে।
কিন্তু সে আথেন্স নাই, সেই গণভোটও নাই। গ্রিসের বামপন্থী শাসক দল সিরিজার নায়ক সিপ্রাস গণতন্ত্র উদ্যাপনের মহত্ উদ্দেশ্য সাধন করিতে গণভোট ডাকেন নাই, তিনি আপনার রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের কৌশল হিসাবে এই চালটি চালিয়াছেন। তাঁহার দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক এবং আইএমএফ-এর সাহায্য ব্যতীত ঋণশোধের সংস্থানও নাই, অথচ সেই সাহায্য লাভের জন্য কর বৃদ্ধি এবং পেনশন ও অন্যান্য সরকারি ব্যয় সংকোচের কঠোর সিদ্ধান্ত লইতে হইবে। ইইউ, ইসিবি ও আইএমএফ-এর সহিত গ্রিস সরকারের টানাপড়েন ব্যর্থ হইলে গ্রিস ইউরো, এমনকী ইইউ হইতে বিচ্ছিন্ন হইতে পারে। এই প্রেক্ষিতেই সিপ্রাস জনসাধারণের সামনে প্রস্তাব পেশ করিয়াছেন: কৃচ্ছ্রসাধনের শর্তাবলি মানিয়া লওয়া ঠিক কি না? কার্যত ইহার অর্থ: গ্রিস ইউরো তথা ইইউয়ের শরিক থাকিবে কি না? সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত যদি ইইউয়ের সঙ্গে থাকিবার পক্ষে হয়, তবে সিপ্রাস এক দিকে তাঁহার দলের এবং জোটের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ কট্টরপন্থীদের প্রতিহত করিতে পারিবেন, অন্য দিকে ইইউ-এ থাকিবার বিনিময়ে উত্তমর্ণদের নিকট আরও কিছু ছাড় আদায় করিতে তৎপর হইবেন, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল তেমন ছাড়ের সম্ভাবনা উড়াইয়া দেন নাই। ইহাই সিপ্রাসের কৌশল।
এই কৌশল চতুরতার পরিচায়ক হইতে পারে, রাজনীতির ময়দানে কার্যসিদ্ধির পক্ষে বিশেষ উপযোগী হইতে পারে, কিন্তু নৈতিকতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হইতে পারে না। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে আইনসভার সদস্যরা নাগরিকদের প্রতিনিধি, নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব তাঁহাদের। এবং, সেই নীতি অনুসারে শাসনতন্ত্র চালাইবার কাজ গণতান্ত্রিক সরকারের। সিদ্ধান্ত তাঁহাদেরই লইতে হইবে, বিপাকে পড়িলে গণভোটের নামে বন্দুকটি নাগরিকদের কাঁধে রাখিয়া যুদ্ধ জয় করিবার কৌশল সুবিধাবাদের নামান্তর। বৃহত্তর বা মৌলিক কোনও নীতির প্রশ্নে গণভোটের যৌক্তিকতা থাকিতে পারে, যেমন সম্প্রতি আয়ার্ল্যান্ডে সমকামী বিবাহের প্রশ্নে গণভোটের ক্ষেত্রে। কিন্তু আর্থিক সংকট হইতে পরিত্রাণের জন্য বলিষ্ঠ নীতি অনুসরণ করিতে ভীত বলিয়া সরকার গণভোট ডাকিতেছে, ইহা গ্রিক গণতন্ত্রের আদি-পুরুষদের সন্তুষ্ট করিত না। বস্তুত, রাজনীতির সাময়িক সুবিধা হইলেও এই পথে দীর্ঘমেয়াদি লাভ হওয়া কঠিন, কারণ ইহাতে সরকারের তথা শাসক গোষ্ঠীর দুর্বলতাই প্রকট হয়, যে দুর্বলতা আর্থিক সংস্কারের পথে বিপুল বাধা স্বরূপ। চালাকি দিয়া সেই দুর্বলতা ঢাকা যায় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy