ক র্ণ জোহর কি ভয় পাইয়াছেন? কর্ণ জোহর কি ব্যবসায়িক স্বার্থে আপস করিয়াছেন ? কর্ণ জোহরের কি হৃদয় পরিবর্তন ঘটিয়াছে? প্রশ্নগুলি সহজ নয়, উত্তরও নয় জানা। কিন্তু ইহাদের কোনও সম্ভাবনাই অলীক নয়। পাকিস্তানের অভিনেতা ফাওয়াদ খানকে তাঁহার নূতন ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দিয়াছিলেন এই চিত্রপরিচালক। ছবির মুক্তিলগ্নে তুমুল শোরগোল, আপত্তি, প্রতিবাদের কাহিনি এখন সর্বজনবিদিত। এই চিৎকার-পর্বে পরিচালক নিজে নীরব ছিলেন। নীরবতা ক্রমশ কর্ণবিদারী হইয়া উঠিতেছিল। অবশেষে তিনি নীরবতা ভাঙিয়াছেন। এবং চমৎকৃত করিয়াছেন। তাঁহার বক্তব্য, তিনি দেশভক্ত, সুতরাং ভবিষ্যতে নিজের চলচ্চিত্রে পাকিস্তানের শিল্পীদের স্থান দিবেন না। এই ছবি যখন তৈয়ারি হয়, তখন পাকিস্তানের সহিত ভারতের শান্তিপ্রক্রিয়া চলিতেছিল, সেই প্রক্রিয়া বানচাল হইয়া গিয়াছে, এখন শান্তির সুবাতাস অন্তর্হিত, বারুদের ঘ্রাণ প্রবল। সুতরাং এখন আর সেই দেশের শিল্পীদের ভারতীয় ছবিতে (বা অন্য কোনও সাংস্কৃতিক পরিসরে) স্থান দেওয়া চলে না। ভবিষ্যতে শান্তির পরিবেশ ফিরিলে, নরেন্দ্র মোদী আবার নওয়াজ শরিফের বাড়িতে ক্ষীর খাইতে গেলে তিনি অন্য রকম ভাবিবেন কি না, তাহা অবশ্য কর্ণ জোহর বলেন নাই।
কর্ণ জোহর নিশ্চয়ই জানেন, দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ থাকিবার সঙ্গে দুই দেশের শিল্প-সংস্কৃতির দুনিয়ার পারস্পরিক লেনদেনের কোনও স্বাভাবিক সংযোগ নাই। সেই সংযোগ যত দুর্বল হইবে, সন্ত্রাসের কারবারি এবং তাহাদের পৃষ্ঠপোষকদের প্রতিপত্তি তত বাড়িবে, ইহাও নিতান্ত কাণ্ডজ্ঞানের কথা। তবুও যে তাঁহাকে এমন প্রতিশ্রুতি জানাইতে হইয়াছে, তাহা একটি সুস্পষ্ট সংকেত বহন করে। উদ্বেগজনক সংকেত। আতঙ্কজনকও বটে। সংকেতটি জানাইয়া দেয় যে, আপন রুচি ও পছন্দ মাফিক সৃষ্টিশীল কাজ করা এ দেশে ক্রমশ কঠিন হইতে কঠিনতর হইতেছে। যাহাদের হাতে যূথশক্তি আছে, তাহারা যদি আপত্তি করে, তবে তেমন কাজ করা চলিবে না। ইহাকে আগমার্কা ফ্যাসিবাদ বলা যায় কি না তাহা লইয়া প্রকাশ কারাট তাঁহার সূক্ষ্মবিচারে ব্যস্ত থাকুন, যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক মানিবেন, ইহা ফ্যাসিবাদের সুস্পষ্ট লক্ষণ।
ফ্যাসিবাদী যূথশক্তির চাহিদা মানিয়া লইয়া তাহাকে নিরস্ত করিবার প্রকল্প দুনিয়ার ইতিহাসে কখনও সার্থক হয় নাই, তাহার সহিত মানুষ যত আপস করিয়াছে, তাহার চাহিদা তত সর্বগ্রাসী হইয়াছে। কর্ণ জোহরও সম্ভবত তাহা প্রথম অঙ্কেই টের পাইতেছেন। মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার এই হুমকি তাঁহার আপস-অবস্থান ঘোষণার পরেও বহাল! ওই হুমকির প্রেক্ষিতেই মহারাষ্ট্রের চলচ্চিত্র প্রদর্শকদের একটি সংগঠন চলচ্চিত্রটি না দেখাইবার সিদ্ধান্ত জানাইয়াছিল, সুতরাং সেই সিদ্ধান্তও বদলাইবার আশা কম। অর্থাৎ চিত্রপরিচালকের মান গেল, ব্যবসাও নিরাপদ হইল না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহার সরকারের আড়াই বছরের ইতিহাস সেই আশ্বাসে ভরসা করিবার রসদ জোগায় না। নাগরিকরা দেখিয়াছেন, অসহিষ্ণুতার কারবারিরা দাপাইয়া বেড়াইয়, নাগরিক সমাজের, বিশেষত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির স্রষ্টা ও পরিবেশকদের উপর তাহাদের আধিপত্য এবং পীড়ন চলে, প্রশাসন অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া থাকে। কে জানে, নরেন্দ্র মোদী হয়তো ‘ন্যূনতম সরকার’ বলিতে ইহাই বোঝেন— যে সরকার (আপন গোঠের) যূথশক্তিকে যথেচ্ছাচারের সুযোগ দিতে নিজেকে গুটাইয়া রাখে। বিশেষত, জাতীয়তাবাদের নামে জঙ্গি উপদ্রবের মোকাবিলায় সত্য সত্যই ‘ন্যূনতম সরকার’-এর অন্তর্ধান লীলা দেখা যাইতেছে। কর্ণ জোহর কী আর করিবেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy