অ্যাপেন্ডিক্স নামক অঙ্গটি নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। উত্পাত না করিলে তবুও তাহার অস্তিত্ব সহ্য করিয়া লওয়া যায়। কিন্তু, তাহার প্রদাহ আরম্ভ হইলে অস্ত্রোপচার করিয়া অঙ্গটিকে ফেলিয়া দেওয়া ভিন্ন আর গতি নাই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ন্যায় প্রতিষ্ঠানকে লইয়া সমস্যা হইল, তাহারা থাকিলেই উত্পাত করে, উত্পাত তাহাদের চরিত্রে নিহিত। বরাবরই দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ইউজিসি’র রকমারি উপদ্রব সহ্য করিতে হইয়াছে। অধুনা তাহার প্রদাহ তীব্রতর। কখনও স্নাতক স্তরে হিন্দি পঠনপাঠনকে আবশ্যিক করিবার চেষ্টা, কখনও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স-এর ন্যায় বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানের উপর খবরদারি কমিশনের অনধিকার চর্চার বিরাম নাই। বল্লভভাই পটেলের জন্মদিনে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জাতীয় সংহতির শপথবাক্য পাঠ করাইবার প্রস্তাবটি তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন। ভারতের ঐক্যবিধানের কৃতিত্ব একা সর্দার পটেলেরই প্রাপ্য কি না, অথবা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে তাঁহার ভূমিকার যথার্থ মূল্যায়ন কী হওয়া বিধেয়, ইতিহাসবিদরা সেই তর্ক করিবেন। ৩১ অক্টোবরের পূর্বেই সেই তর্কের মীমাংসায় পৌঁছাইতে হইবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতাও নাই। কারণ, মঞ্জুরি কমিশন অনধিকার চর্চা করিতেছে কি না, তাহা বুঝিতে এই প্রশ্নগুলির উত্তরের প্রয়োজন নাই। ছাত্রদের শপথবাক্য পাঠ করানো ইউজিসি-র কর্তব্যের অন্তর্গত নহে। যে কোনও শপথের ক্ষেত্রেই কথাটি সমান সত্য। সর্দার পটেল এই ক্ষেত্রে উপলক্ষমাত্র।
কেন সর্দার পটেলই উপলক্ষ হইলেন, তাহা অনুমানযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁহার প্রতি নিজের অনুরাগ প্রায় ছয়শত ফুট দীর্ঘ মূর্তিতে অমর করিয়া রাখিতে বধ্যপরিকর। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্তারা যদি সর্দার পটেলকে ছুঁইয়া প্রধানমন্ত্রীর মন রাখিতে চাহেন, এই কর্তাভজা সভ্যতায় তাঁহাদের বিশেষ দোষ দেওয়া কঠিন। এখানেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। তিনি যে এই পথটিকে সমর্থন করেন না, সেই কথাটি স্পষ্ট করিয়া বলিতে হইবে। কিন্তু সেই আলোচনা অন্যত্র। সর্দার পটেলের জন্মদিনে দেশ জুড়িয়া ছাত্রদের শপথবাক্য পাঠ করাইবার যে পরিকল্পনা ইউজিসি করিয়াছে, তাহা দার্শনিক ভাবে শিক্ষার বিপ্রতীপ। শিক্ষার প্রথম শর্তই হইল মুক্ত মনের অধিকার। লাইনে দাঁড়াইয়া রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট শপথবাক্য পাঠ করাইলে সেই মুক্তিকেই খণ্ডন করা হয়। এই শৃঙ্খলা আরোপের মূল উদ্দেশ্য চিন্তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া এমন হস্তক্ষেপ কম দেখে নাই। তাহাতে সকলে নিয়মমতে চলিতে শেখে বটে, কিন্তু সেই চলায় শেষ পর্যন্ত ক্ষতি রাষ্ট্রেরই। ভারতের যাহাতে সেই ক্ষতি না হয়, তাহা নিশ্চিত করা প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য।
আরও একটি কর্তব্য আছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নামক অ্যাপেন্ডিক্সটিকে রাষ্ট্রের শরীর হইতে ছাঁটিয়া ফেলা। প্রতিষ্ঠানটির জন্ম ১৯৫৬ সালে। সময়টি লক্ষণীয়। তখন ভারতে রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের স্বর্ণযুগ চলিতেছে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা আসিয়াছে, রেলের মাসুল সমীকরণ হইতেছে, দেশ জুড়িয়া কেন্দ্রীয় সরকারের ‘উন্নয়ন-যজ্ঞ’ আরম্ভ হইয়াছে। শিক্ষাকেও রাষ্ট্র দখল করিতে চাহিবে, তাহাতে আশ্চর্য কী? কিন্তু, সেই দিন গিয়াছে। যোজনা কমিশন যে পথে গিয়াছে, ইউজিসি-ও সেই পথেই যাউক। ইউজিসি তাহার ঘোষিত লক্ষ্যগুলি পূরণে সফল হইয়াছে, এমন দাবি করিবার উপায় নাই। হইবে, সেই আশা ক্ষীণতর। অনধিকার চর্চাই তাহার মূল কাজ হইয়াছে। আর তাহার প্রয়োজন নাই। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি স্বনিয়ন্ত্রিত হউক। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও সরকার ও বিশ্ববিদ্যলয়গুলির মধ্যে কমিশনের উপস্থিতি অপ্রয়োজনীয়। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক কাজটি করিতে পারিবে। কমিশনের ষাট বত্সর পূর্ণ হইতে চলিয়াছে। এই বার তাহার চির-অবসর প্রাপ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy