Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

জরুরি আশ্বাস

কো নও বিচারের চূড়ান্ত রায় বাহির হইতে যদি একুশ বৎসর লাগিয়া যায়, তাহা দেশের বিচারব্যবস্থা বিষয়ে সঙ্গত উদ্বেগ তৈরি করে। আবার যদি তাহা এমন একটি গুরুতর মামলা হয় যেখানে রাজ্যের কোনও প্রাক্তন কিংবা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী জড়িত, এবং যেখানে অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট অর্থের পরিমাণ ভয়ঙ্কর রকমের বেশি, তবে তো কথাই নাই।

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

কো নও বিচারের চূড়ান্ত রায় বাহির হইতে যদি একুশ বৎসর লাগিয়া যায়, তাহা দেশের বিচারব্যবস্থা বিষয়ে সঙ্গত উদ্বেগ তৈরি করে। আবার যদি তাহা এমন একটি গুরুতর মামলা হয় যেখানে রাজ্যের কোনও প্রাক্তন কিংবা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী জড়িত, এবং যেখানে অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট অর্থের পরিমাণ ভয়ঙ্কর রকমের বেশি, তবে তো কথাই নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ভাবনা উপস্থিত হয় দেশের রাজনীতির চরিত্র বিষয়েও, কেননা বুঝিতে কষ্ট হয় না যে বিচার-পর্বের যাত্রাপথের এই আত্যন্তিক দৈর্ঘ্য মোটেই আপতিক নয়, বরং একান্ত ভাবে রাজনীতি-প্রভাবেই নির্ধারিত। রাজনৈতিক ক্ষমতাবলয় কত কঠোর ফাঁসে স্বাভাবিক বিচারের পথকে রুদ্ধ করিতে পারে, ভারতের নানা প্রদেশের নানা ঘটনার মধ্যেও জয়ললিতা ও তাঁহার রাজনৈতিক সঙ্গীবর্গের এই ‘ডিসপ্রোপোরশনেট অ্যাসেট’ মামলা তাহার একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হইয়া থাকিবে। অবশ্যই সব মিলাইয়া ইহা হইতে তামিলনাড়ু রাজনীতি সম্বন্ধে ভাল ধারণা তৈরি হয় না। ভারতীয় রাজনীতির বৃহত্তর পরিবেশ সম্বন্ধেও নিরুদ্বেগ থাকা যায় না। সত্য বলিতে কী, এই দ্বিতীয় উদ্বেগটি নিশ্চিত ভাবেই বিচারের বিলম্বিত প্রক্রিয়া বিষয়ে প্রথম উদ্বেগকে কয়েক গুণ ছাপাইয়া যায়। রাজনীতি যদি এ ভাবেই সামাজিক ন্যায় ও নৈতিকতার কণ্ঠ রুদ্ধ করিতে করিতে নিজের আখের গুছাইয়া চলে, ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল্য আবার প্রথম হইতে বিবেচনা করা দরকার।

যে একুশ বৎসর এআইএডিএমকে-র শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দুর্নীতির এই মামলা চলিয়াছে, তাহার মধ্যে চৌদ্দো বৎসরই অভিযু্ক্ত নেত্রী ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সহজেই বোঝা যায়, কী প্রবল প্রতিরোধের মধ্যে সেই প্রদেশের ডিরেক্টরেট অব ভিজিল্যান্স অ্যান্ড অ্যান্টি-করাপশনকে কাজ করিতে হইয়াছে, তদন্ত চালাইতে হইয়াছে। পুলিশ ও প্রশাসনের তুমুল অসহযোগিতার মধ্যে ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব, এমনকী বিরোধী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ মুখের কথা নয়। কঠিন হুমকির মুখে তাঁহাদের কাজ করিতে হইয়াছে, ত্রাসের পরিবেশে নীতিনিষ্ঠ থাকিতে হইয়াছে। বিচারব্যবস্থার বিলম্বিত প্রক্রিয়াটির নেপথ্যে প্রচ্ছন্ন এই নিষ্ঠা ও সাহসিকতাকে কিন্তু আজ অগ্রাহ্য করা যাইবে না। বিশেষ করিয়া নিম্ন আদালত যে জয়ললিতার বিরুদ্ধে রায় দিতে পারিয়াছিল, তাহা দৃষ্টান্তস্বরূপ হইয়া থাকিবে। পরবর্তী কালে হাইকোর্টে রায় পাল্টাইয়া গেলেও সু্প্রিম কোর্ট নিম্ন আদালতের রায়কে প্রতিষ্ঠা দিয়া বিচারপ্রক্রিয়ার অন্তর্লীন ন্যায়পরায়ণতা এবং স্পষ্টতার প্রতি ভরসা ফিরাইয়া দিয়াছে।

এই ভরসাটিই আজকের ভারতে দিগদর্শন হইলে মঙ্গল। দেশের সর্বত্র সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবের বাহিরে গিয়া যদি অভিযোগভিত্তিক তদন্ত ও তদন্তভিত্তিক বিচার আয়োজন করা সম্ভব হয়, তবেই ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সুস্থতার আশা আছে। সরকারি অনুমতি ছাড়া দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মীর (যে কোনও স্তরেরই হউক) বিরুদ্ধে যে কোনও খোঁজখবরই করা যায় না, সেই স্বীকৃত ধারাটির বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইবার একমাত্র পথ— রুখিয়া দাঁড়ানো। এই মামলা দেখাইয়া দিল, তাহা অসম্ভব নয়। প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রীর সহচরী শশিকলা ইতিমধ্যেই বিপুল পরিমাণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আত্মসাৎ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও আজ সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তাঁহাকে রাতারাতি উচ্চাসন হইতে নামিয়া জেলাসন গ্রহণ করিতে হইল। অতঃপর রাজনীতি কোন দিকে বাঁক লইবে, কোন ব্যক্তি এআইএডিএমকে দলনেতা হইবেন, কোন ব্যক্তি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হইবেন, এই সকল তথ্য অপেক্ষা অবশিষ্ট দেশের কাছে এই ভরসার বার্তাটি অনেক গুণ বেশি জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE