Advertisement
১৯ মে ২০২৪
প্রবন্ধ‌ ১

জোটের অঙ্ক আর স্থানীয় রাজনীতি

পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস যদি জোট বাঁধে, তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা কতখানি? বিহারে যদি দুই চিরশত্রুর জোট সফল হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে অন্যথা হবে কেন?দেখা যাচ্ছে, হাত ধরতে আগ্রহ দু’পক্ষেরই। এক দিকে সূর্যকান্ত মিশ্র আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা বলছেন, কংগ্রেসকে জোটের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আর অন্য দিকে কংগ্রেসেরও দৃশ্যত কোনও আপত্তি নেই।

 যৌথ সাফল্য। সিপিআইএম ও কংগ্রেস সমর্থকদের উল্লাস। ইংলিশ বাজার, ২০১৩।

যৌথ সাফল্য। সিপিআইএম ও কংগ্রেস সমর্থকদের উল্লাস। ইংলিশ বাজার, ২০১৩।

সন্দীপ মিত্র ও শুভময় মৈত্র
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:১০
Share: Save:

দেখা যাচ্ছে, হাত ধরতে আগ্রহ দু’পক্ষেরই। এক দিকে সূর্যকান্ত মিশ্র আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা বলছেন, কংগ্রেসকে জোটের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আর অন্য দিকে কংগ্রেসেরও দৃশ্যত কোনও আপত্তি নেই। প্রশ্ন হল, একদা প্রবল প্রতিপক্ষ, এবং বর্তমানে একই শত্রুর বিরুদ্ধে ল়ড়ে চলা দল দুটি জোট বাঁধলে কি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের ফলে তার বড় কোনও প্রভাব পড়তে পারে? রাজনীতিতে অনেক সময় পাটিগণিত অপ্রযোজ্য। এই ময়দানে হামেশাই দুই আর দুইয়ে সাড়ে পাঁচ হচ্ছে, এমনকী বাইশও হচ্ছে কখনও কখনও। কিন্তু, বস্তুনিরপেক্ষ ভাবে জোটের সম্ভাবনা বিচার করতে হলে সংখ্যাই একমাত্র ভরসা। পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে, এবং ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভোটদানের ধরনটিকে বিধানসভার মানচিত্রে ভেঙে আমরা দেখতে চেষ্টা করেছি, কংগ্রেস-বামপন্থী জোট হলে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট-ভাগ্যে আঁচড় পড়বে কি না।

লোকসভা ভোটের হিসেবকে বিধানসভার আসনে ভাগ করলে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের চারটি রাজনৈতিক শক্তি— তৃণমূল কংগ্রেস, বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং বিজেপি-র ঝুলিতে ভোট যাবে যথাক্রমে ৩৯.৮, ২৯.৯, ৯.৭ এবং ১৬.৮ শতাংশ। আসনসংখ্যা দাঁড়াবে যথাক্রমে ২১৪, ২৮, ২৮ এবং ২৪। বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের জোট হলে প্রাপ্ত ভোটের হার অপরিবর্তিত রেখে যদি এই দুই দলের ভোট যোগ করে দেওয়া হয়, তবে তাদের সম্মিলিত ভোটের ভাগ দাঁড়াবে ৩৯.৬ শতাংশ, এবং আসনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯৭। সে ক্ষেত্রে, তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি-র ভোটের ভাগ অপরিবর্তিত থাকলেও আসন কমে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১৭৯ এবং ১৮। অর্থাৎ, জোট হলে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস, উভয় দলের আসনসংখ্যাই বাড়লেও তাতে তৃণমূল কংগ্রেসের দুশ্চিন্তার কোনও কারণ থাকছে না।

তবে, এ তো নেহাত পাটিগণিতের হিসেব। গত লোকসভা নির্বাচনের ভোট ভাগের হিসেব আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে অপরিবর্তিত থাকবে, ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। বিশেষত, গত লোকসভা নির্বাচনে দেশ জুড়ে ওঠা মোদী-ঝড়ের আঁচ পশ্চিমবঙ্গেও পড়েছিল, এবং বিজেপি-র ভোট বেড়েছিল তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে। কিন্তু, গত দেড় বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হওয়া বিভিন্ন নির্বাচনের ফলাফলকে মাপকাঠি মানলে বলতেই হবে, ঝড়ের প্রাবল্য প্রায় উবে গিয়েছে। গোটা দেশের ধারা পশ্চিমবঙ্গেও বজায় থাকলে আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি-র ভোট কমতে পারে। সেই ভোট কোন দিকে যাবে, তার ওপর বাম-কংগ্রেস জোটের সাফল্য নির্ভর করবে। যদি তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে যায়, তবে নিখুঁত জোট গড়েও বাম-কংগ্রেসের ভাগ্য ফিরবে না। কিন্তু, বিজেপি থেকে ভোট যদি জোটের দিকে যায়? তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট অক্ষুণ্ণ থাকলে বিজেপি-র ভোট জোটের দিকে গেলে ছবিটা কেমন দাঁড়াবে, সঙ্গের সারণির দিকে তাকালে সেই ছবিটা স্পষ্ট হবে।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যে ১৬.৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, তার মধ্যে থেকে ছয় শতাংশ-বিন্দু ভোট বেরিয়ে গিয়ে যদি পুরোটাই জোটের ঝুলিতে যায়, তবে ২০১৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেসকে হারিয়ে রাজ্যে বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় আসতে পারে।

কিন্তু, এই হিসেবও শেষ অবধি পাটিগণিতেরই। রাজনীতির জমিতে ঠিক কী চলছে, সেটাই স্থির করে দেবে জোটের ভাগ্য। যদি একেবারে নীচু স্তরের কর্মীরা ‌যদি জোট মানেন, এবং জোটের স্বার্থে কাজ করেন, একমাত্র তখনই জোট সফল হতে পারে। এ দিকে, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের কর্মীদের মধ্যে বিরোধের ইতিহাস দীর্ঘ। কাজেই, জোট করতে হলে কর্মীদের সেই বৈরর কথা ভুলতে হবে। ভোলার জন্য যথেষ্ট কারণ চাই। পশ্চিমবঙ্গে সেই কারণটি আছে কি না, সেটাই মূল প্রশ্ন।

স্বভাবতই এখানে বিহারের সাম্প্রতিক নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসবে। বলতেই পারেন, রাষ্ট্রীয় জনতা দল আর জনতা দল (ইউনাইটেড)-এর কর্মীরা যদি তাঁদের তিক্ত বিরোধের ইতিহাস ভুলে এক সঙ্গে লড়ে বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়তে পারেন, পশ্চিমবঙ্গেই বা বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস কর্মীরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে একজোট হতে পারবেন না কেন? সত্যি কথাটা হল, রাজনীতির ময়দানে মতাদর্শই একমাত্র চালিকাশক্তি নয়। পশ্চিমবঙ্গে নিশ্চিত ভাবেই অনেক মতাদর্শগত লড়াই হয়েছে, কিন্তু রাজনীতির খেলায় আরও বড় শক্তির নাম অর্থনীতি। কোন অবস্থানে থাকলে আর্থিক লাভ সর্বাধিক, সেই প্রশ্নের উত্তরই বহু ক্ষেত্রে ভোটারদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। এবং, অর্থনীতির লাভ-ক্ষতির হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিহারের দূরত্ব অনেক।

তার কারণ, পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যতখানি সফল ও কার্যকর, বিহারে তার ধারেকাছেও নয়। কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েতি রাজ মন্ত্রক প্রতি বছর পঞ্চায়েতের ক্ষমতায়নের সূচক তৈরি করে। যে রাজ্য ক্রমতালিকায় যত ওপরে, সে রাজ্যে পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থা তত বেশি ক্ষমতায়িত, এবং সচল। পশ্চিমবঙ্গ সেই ক্লাসের ফার্স্ট বয়, দেশের অগ্রগণ্য রাজ্যগুলির একটি। আর, বিহার পিছিয়ে পড়াদের দলে। সেখানেই এই দুই রাজ্যের মধ্যে ফারাক। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ক্ষমতাবান, এবং বহু আর্থিক লেনদেন পঞ্চায়েতের মাধ্যমে হয়, ফলে পঞ্চায়েতের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় স্তরের নেতা-কর্মীরা সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, ভোটের ময়দানে তাঁদের কথার দাম আছে। এ দিকে, পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘকালীন নির্বাচনী ফলাফল দেখলে স্পষ্ট, বিজেপি বাদে তিনটি বড় দলেরই একটি প্রায়-নির্দিষ্ট ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে। এবং, পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু ভোটের একটা স্থিতিজাড্য রয়েছে, ফলে সাধারণ পরিস্থিতিতে ভোটব্যাঙ্ক মোটামুটি অচলা। স্থানীয় স্তরে সেই ভোটব্যাঙ্ক স্থানীয় নেতার নিয়ন্ত্রণেই থাকে। সর্বভারতীয়, এমনকী রাজ্য স্তরের নেতারাও যে সেই ভোটব্যাঙ্ককে তেমন ভাবে প্রভাবিত করতে পারেন না, তার প্রমাণ আগের নির্বাচনগুলিতে রয়েছে। কাজেই, দিল্লি থেকে সনিয়া গাঁধীরা পশ্চিমবঙ্গে জোট চাপিয়ে দিলেই তা হাইকম্যান্ডের পরিকল্পনামাফিক চলবে, তেমনটা না-ই হতে পারে। বিহার আর পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু এক নয়।

বিহারের সঙ্গে এই রাজ্যের আরও একটি ফারাক হল, সেখানে যেহেতু পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তেমন জোরদার নয়, ফলে পঞ্চায়েতের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে সাধারণ মানুষের তেমন মাথাব্যথাও নেই। পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু আছে। সেই কারণেই, দিল্লি থেকে এই রাজ্যের জন্য বড় প্যাকেজ ঘোষণা করলেই নির্বাচনী ময়দানে তার ফল না-ও মিলতে পারে। বিহারেও অবশ্য মেলেনি, কিন্তু তার কারণ পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে আলাদা। এই রাজ্যে উন্নয়ন খাতে মোট কত টাকা এল, সাধারণ মানুষের কাছে তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল, আমার পঞ্চায়েতে কী এল। দিল্লির প্যাকেজ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না।

এবং, প্যাকেজে যা থাকবে, যা থাকে, তা নিয়েও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের তেমন আগ্রহ নেই। বিহার প্যাকেজে যা ছিল, সেটাই কেন্দ্রীয় প্যাকেজে থাকার কথা— মূলত পরিকাঠামো খাতে অনুদান। সেই টাকায় সড়কের উন্নতি হলে সবারই লাভ, কিন্তু ভোট দেওয়ার সময় সেই লাভের কথা তেমন মনে থাকে না। তার চেয়ে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে ছোট, কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রাপ্তি। যেমন, কন্যাশ্রী প্রকল্পে পাওয়া সাইকেল। যেমন, স্থানীয় ক্লাবের হাতে আসা টাকা। যেমন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে করে খাওয়ার সুযোগ।

কেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ক্ষুদ্র প্রত্যক্ষ প্রাপ্তিকেই বেশি গুরুত্ব দেন, সেই প্রশ্নের উত্তর বহুমাত্রিক। প্রথমত, স্থানীয় স্তরে পাইয়ে দেওয়ার যে নীতি বামফ্রন্ট সরকার নিয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেস তাকে কার্যত শিল্পের স্তরে নিয়ে গিয়েছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উপার্জন করা এখন পশ্চিমবঙ্গের মূলধারার জীবিকা। এই রাজ্যে শিল্প না থাকাই তার প্রধান কারণ। আবার, স্থানীয় স্তরে ছোট প্রাপ্তিকে পরিকাঠামোর উন্নতির দীর্ঘমেয়াদি প্রাপ্তির তুলনায় কম গুরুত্ব দেওয়ার কারণও শিল্পহীনতা। যেহেতু বিধান রায়-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস শুধু অবশিল্পায়নেরই, এই রাজ্যের মানুষ তাতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। শিল্প হলে যে তার সুফল সবার কাছে পৌঁছোবে, এবং আখেরে তাতে লাভ খুচরো সিন্ডিকেটের তুলনায় ঢের বেশি হবে, এই কথাটি রাজ্যের মানুষ হয়তো খাতাকলমে মানেন, কিন্তু বাস্তবে নয়। এখন তৃণমূল, সিপিআইএম, সব দলই শিল্পের কথা বলছে, শিল্পের দাবিতে মিছিল করছে। কিন্তু, শুধু সেটুকুর জোরেই রাজ্যের মানুষের অর্ধশতকের অভ্যাস বদলে দেওয়া যাবে, শিল্পায়নের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দেওয়া যাবে, এমনটা ভাবলে মস্ত ভুল হবে। রাজ্যের মানুষ নিজেদের প্রাপ্তির জন্য শিল্পায়নের সম্ভাবনাকে বলি দিতেই পারেন। তাই তাঁদের কাছে কন্যাশ্রীর সাইকেলের তুলনায় পরিকাঠামো খাতে বড় অনুদানের গুরুত্ব কম হতেই পারে।

অর্থনীতির এই যুক্তির পাশাপাশিই থাকছে আরও কয়েকটি প্রশ্ন। যেমন, সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলিতে অনুপ্রবেশের প্রশ্ন গুরুত্ব পাবে। এবং, সেই প্রশ্নে স্থানীয় নেতাদের অবস্থান যদি দলের কেন্দ্রীয় অবস্থানের সঙ্গে না মেলে, সেই বিরোধে স্থানীয় স্তরের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি। অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চোরা স্রোত বাড়ছে। ভোটের মেরুকরণ হলে বিজেপি আর তৃণমূলের লাভ, জোটের ক্ষতি।

অতীতের অভিজ্ঞতাও বলছে, সর্বভারতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা থেকে পশ্চিমবঙ্গের ওপর জোট চাপিয়ে দিয়ে লাভ হয়নি। ছোট প্রশ্নগুলিকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিয়ে বিচার করলে হয়তো নতুন পথের সন্ধান পাওয়া গেলেও যেতে পারে। সর্বোচ্চ থেকে একেবারে নিচু তলা, সব স্তরের স্বার্থ এক সরলরেখায় না পড়লে জোটের অঙ্ক মেলানো, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে, কঠিন কাজ।

কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE