Advertisement
১১ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

জাতীয়তার তাড়না

সমস্ত মানুষের সমান অধিকারের ধারণাটিই মানবাধিকারের মূলে। কিন্তু মানবাধিকার কি সত্যই সর্বজনীন? না কি, যে সকল ক্ষমতাহীনদের হইয়া লড়াই করিবার জন্য কোনও সংগঠিত শক্তি রহিয়াছে, বিশেষত সেই গোষ্ঠীর নির্বাচনী গুরুত্ব রহিয়াছে, মানবাধিকার কেবল তাহাদের জন্য?

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

সমস্ত মানুষের সমান অধিকারের ধারণাটিই মানবাধিকারের মূলে। কিন্তু মানবাধিকার কি সত্যই সর্বজনীন? না কি, যে সকল ক্ষমতাহীনদের হইয়া লড়াই করিবার জন্য কোনও সংগঠিত শক্তি রহিয়াছে, বিশেষত সেই গোষ্ঠীর নির্বাচনী গুরুত্ব রহিয়াছে, মানবাধিকার কেবল তাহাদের জন্য? তেমন সংগঠন বা গুরুত্ব না থাকিলে মানবাধিকারের বিশ্ববন্দিত প্রতিমূর্তিও নীরব এবং উদাসীন থাকিতে পারেন? মায়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনজাতির প্রতি সংখ্যাগুরুর অমানবিক অত্যাচার এবং রাষ্ট্রের অমার্জনীয় ঔদাসীন্য দেখিয়াও সে দেশের জননেত্রী, নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক আউং সান সু চি নীরব। দুনিয়া জানিয়াছে যে, সু চি তাঁহার দেশের নিপীড়িত মানুষের লুণ্ঠিত ও লাঞ্ছিত মানবাধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করিয়াছেন, করিতেছেন। মায়ানমারে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁহার সংগ্রাম সেই বৃহত্তর মানবাধিকার আন্দোলনের সহিত অন্বিত। এই কারণেই তিনি মানবাধিকারের স্বীকৃত প্রতীক।

কিন্তু আজ যখন মায়ানমারে স্বৈরশাসনের মেঘ ধীরে ধীরে কাটিতেছে, সু চি-র সামনে নির্বাচনী গণতন্ত্রের পথে রাষ্ট্রপরিচালনার সুযোগ ক্রমশ অগ্রবর্তী হইতেছে, তখন দেখা যাইতেছে, তাঁহার মানবাধিকার-চেতনা সকলের জন্য জাগ্রত নহে, রোহিঙ্গা ও অন্য জনজাতীয় মানুষের নিপীড়ন তাঁহাকে উদ্বেল করে না। এই বিষয়ে তাঁহাকে প্রশ্ন করিলেও তিনি সেই প্রশ্ন কূটনীতির কৌশলে এড়াইয়া যান। দলাই লামা বা বিশপ টুটু-র মতো নাগরিকের কণ্ঠে এই কারণে তাঁহার সমালোচনা ধ্বনিত হইবার পরেও সু চি আপন অবস্থানে অবিচল থাকেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিয়াছে, তবে কি মায়ানমারের বিশ্বমানবী আপন দেশে কেবল সংখ্যাগুরুর মানবাধিকার রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ? সু চি-র নীরবতার কারণ কি ইহাই যে, দেশের সংখ্যাগুরুদের তিনি ক্ষুব্ধ করিতে চাহেন না, কারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতাই মূলধন? যে সম্প্রদায়ের হইয়া লড়াই করিলে তাঁহার রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণ হইবে, তাঁহার লড়াই কেবল তাহার জন্য? নোবেল শান্তি কমিটি তাঁহাকে ‘ক্ষমতাহীনদের ক্ষমতা’র প্রতীক বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন। সেই প্রতীক কি শেষ অবধি রাজনৈতিক ক্ষমতার পায়ে আপনাকে বিসর্জন দিল?

রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চি-র নীরবতা জাতীয়তাবাদের সমস্যাসঙ্কুল ধারণাটিকে নূতন করিয়া সামনে আনিয়াছে। স্মরণীয়, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য একাধিক বার বিবেচিত হইয়াও কোনও বার পুরস্কার পান নাই। তাহার অন্যতম কারণ দর্শানো হইয়াছিল ইহাই যে, গাঁধীজি এক জন অসাধারণ শান্তিকামী মানব হইলেও তিনি একই সঙ্গে, বস্তুত সর্বাগ্রে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী, সুতরাং বিশ্বমানবের প্রেক্ষিতে তাঁহার গুরুত্ব সেই অনুপাতে খর্বিত। এই সিদ্ধান্তে গাঁধীজির প্রতি যে অবিচার হইয়াছিল, তাহার আলোচনা অন্যত্র। কিন্তু এই সূত্রেই যে সু চি’র নোবেল শান্তি পুরস্কার সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে, সে কথা অনস্বীকার্য। যে জাতীয়তাবাদ নিজেকে সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাদে সীমিত করে, তাহার মহত্ত্ব মানিয়া লওয়া কঠিন, সেই গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠতার গৌরবে গৌরবান্বিত হইলেও। মানিতেই হইবে, গাঁধীজির জাতীয়তার ধারণা ক্ষুদ্রতার পিছুটান অতিক্রম করিয়া আপনাকে প্রসারিত করিতে চাহিয়াছিল। আউং সান সু চি, নির্বাচনের তাড়নায় হউক অথবা আপন জাতিগোষ্ঠীগত অভিমানের প্রেরণায় হউক, উল্টো রথের সওয়ার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE