প্রকল্পের নামের অগ্রভাগে ‘জাতীয়’ শব্দটি থাকিবে কি না, তাহা নিতান্তই নামদাতার ইচ্ছা। নামে কী-ই বা আসে যায়? কিন্তু, শব্দটির উপস্থিতিমাত্রেই প্রকল্পটি প্রকৃত অর্থে ‘জাতীয়’ হইবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নাই। বস্তুত, ভারতে জাতীয় প্রকল্প কথাটি নামমাত্র। প্রকৃত প্রস্তাবে এই প্রকল্পগুলি কেন্দ্রীয়। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থানুকূল্যে চলা, এবং সেই কারণেই দেশ জুড়িয়া ব্যাপ্ত। জাতীয় গঙ্গা রিভার বেসিন অথরিটি যেমন। প্রধানমন্ত্রী গঙ্গা সাফ করিতে চাহিয়াছেন। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। অতএব, তাহা কেন্দ্রীয় প্রকল্প হইয়াছে। ইহাতে দূষণীয় কিছু নাই। কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন প্রকল্প চালাইয়াই থাকে। কিন্তু, সেই প্রকল্পের বৈঠকে রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের উপস্থিত থাকিতেই হইবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা থাকিতে পারে না। স্বভাবতই আপত্তি উঠিয়াছে। কেন্দ্রের নীতি নির্ধারণের বৈঠকে রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের উপস্থিতি আবশ্যিক করিবার প্রচেষ্টাটি যে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ধর্মের পরিপন্থী, সেই কথা অনেক মুখ্যমন্ত্রীই বলিতেছেন। অতএব, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপস্থিতি লইয়া প্রশ্ন তুলিবার কারণ নাই। নীতি আয়োগের বৈঠকে হাজির না থাকা আর গঙ্গা দূষণের বৈঠকে অনুপস্থিতিকে এক করিয়া ফেলা ভুল হইবে।
প্রশ্ন উঠিবে, কেন্দ্রীয় প্রকল্প আর জাতীয় প্রকল্পে ফারাক কী? ফারাক তাহাদের ব্যাপ্তিতে নহে। দুইটি ক্ষেত্রেই প্রকল্প দেশব্যাপী হওয়াই স্বাভাবিক। প্রকল্পটি কাহার নেতৃত্বে চলিবে, ফারাক সেখানেও নহে। যেহেতু প্রকল্পগুলি চরিত্রে দেশব্যাপী, স্বভাবতই কোনও একটি রাজ্যের পক্ষে তাহা চালানো অসম্ভব। অতএব, জাতীয় প্রকল্পও কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বেই চলিবে। ফারাক প্রকল্পের ভাবনা ও পরিকল্পনায় রাজ্যগুলির ‘এজেন্সি’ বা সক্রিয় অংশীদারির চরিত্রে। অর্থাৎ, রাজ্যের এজেন্সি-র মাত্রার উপর নির্ভর করিবে, কোন প্রকল্প নিছক কেন্দ্রীয়, আর কোনটি প্রকৃত প্রস্তাবেই জাতীয়। জাতীয় প্রকল্পের ভাবনা হইতে রূপায়ণ, প্রতিটি স্তরে রাজ্যগুলির প্রকৃত অংশীদারি থাকিতেই হইবে। তাহাই যুক্তরাষ্ট্রীয়তার শর্ত। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সে দায় নাই। সেই প্রকল্পের রূপায়ণের আংশিক দায়িত্ব রাজ্যগুলির উপর চাপাইয়া দিলেই যথেষ্ট হয়। ভারতে এ যাবৎ কাল তাহাই হইয়াছে। কেন্দ্র ভাবিয়াছে, রাজ্যগুলি বড় জোর সেই ভাবনার আঁচ পাইয়াছে। জাতীয় কর্মসংস্থান যোজনাই হউক বা পানীয় জল প্রকল্প, রাজ্যগুলি শুধু হুকুম তামিল করিয়াছে। নরেন্দ্র মোদীও একই পথে হাঁটিলেন। গঙ্গার দূষণমুক্তি বিষয়ে তাঁহার যে ভাবনা, তিনি তাহা রাজ্যগুলির উপর চাপাইয়া দিলেন মাত্র। রাজ্যগুলির মতপ্রকাশের অবকাশ রাখিলেন না। তাহারা আদৌ এমন প্রকল্প চাহে কি না, বলিবার ফাঁক রাখিলেন না। যুক্তরাষ্ট্রীয়তার পক্ষে তিনি যত বাক্যব্যয় করিয়াছেন, তাহার সহিত এই আচরণ বেমানান।
রাজ্যগুলির মুখ্যসচিবদের সহিত প্রধানমন্ত্রীর ভিডিয়ো কনফারেন্সে সরাসরি আলোচনা করিতে চাহিবার সিদ্ধান্তের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের লক্ষণ নাই। প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রশাসনিক প্রধান হইতে পারেন, কিন্তু রাজ্যের মুখ্যসচিবরা রাজ্য সরকারের অধীন। তাঁহারা স্ব স্ব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নিকট দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতাকে সম্মান করিবার দায়িত্ব সকলের, প্রধানমন্ত্রীরও। কোনও প্রকল্পকে বেগবান করিতে তিনি এই সাংবিধানিক কাঠামোকে অস্বীকার করিতে পারেন না। একদা রাজীব গাঁধীও একই গোত্রের ভুল করিয়াছিলেন। রাজ্যের সহিত আলোচনা চালাইতে হইলে তাহা মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে চালানোই শোভন। কোনও মুখ্যমন্ত্রী যদি অসহযোগী হন, তিনি যদি নিজের রাজ্যের স্বার্থের কথাও না ভাবেন, তবে তাঁহার রাজ্য ভুগিবে। কিন্তু, তাঁহাকে এড়াইয়া প্রধানমন্ত্রী আমলাদের নিকট পৌঁছাইতে চাহিলে তাহা যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ধর্মকে উল্লঙ্ঘন করিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy