Advertisement
১১ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

তৃতীয় অস্তিত্ব

নারী ও পুরুষ, এই দুই লিঙ্গের খোপে যে পৃথিবীর যাবতীয় মানুষকে ধরিয়া বাঁধিয়া আঁটিয়া রাখা যায় না, এই সত্য ঘোষণা করিয়াছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। তৃতীয় লিঙ্গের বাস্তব অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু এত দিন পর্যন্ত এমন স্বীকৃতি তাঁহাদের মেলে নাই। পরিবার পরিজনদের দ্বারা নির্বাসিত বৃহন্নলারা পেটের দায়ে বাছিয়া লইতে বাধ্য হইতেন যৌনকর্মী কিংবা ভিক্ষুকের অসম্মানিত জীবন। মহাভারতে নায়ক অর্জুনের ছদ্মনাম বৃহন্নলা।

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

নারী ও পুরুষ, এই দুই লিঙ্গের খোপে যে পৃথিবীর যাবতীয় মানুষকে ধরিয়া বাঁধিয়া আঁটিয়া রাখা যায় না, এই সত্য ঘোষণা করিয়াছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। তৃতীয় লিঙ্গের বাস্তব অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু এত দিন পর্যন্ত এমন স্বীকৃতি তাঁহাদের মেলে নাই। পরিবার পরিজনদের দ্বারা নির্বাসিত বৃহন্নলারা পেটের দায়ে বাছিয়া লইতে বাধ্য হইতেন যৌনকর্মী কিংবা ভিক্ষুকের অসম্মানিত জীবন। মহাভারতে নায়ক অর্জুনের ছদ্মনাম বৃহন্নলা। বিরাটরাজ্যে অজ্ঞাতবাসের সময় না-নারী, না-পুরুষ অস্তিত্বে অর্জুন সফল ভাবে আত্মগোপন করিয়াছিলেন। এই তৃতীয় অস্তিত্বের উপযোগিতা মহাভারতে স্বীকৃত। কিন্তু ওই অবধিই। বৃহন্নলা তো নায়ক অর্জুনের নিতান্ত শাপগ্রস্ত দশা, সে শাপে বরই হইয়াছিল। ভারত কিন্তু বৃহন্নলাদের স্বাভাবিক মানুষের স্বীকৃতি প্রদান করে নাই। সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই অভিশাপকে মুছিয়া দিতে সহায়তা করিবে। অমানবিকতার অবসান ঘটাইবার ইহা প্রথম সোপান।

সর্বোচ্চ আদালতের রায় তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি প্রদান করিয়াই থামিয়া যায় নাই। বেশ প্রবল মনোভাব লইয়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য বিশেষ সংরক্ষণের কথা বলিয়াছে। কেন এই সংরক্ষণের ব্যবস্থা? এক দিক হইতে ইহা যেন পাপের ও অমানবিক আচরণের প্রায়শ্চিত্ত। এত কাল পর্যন্ত ‘স্বাভাবিক’ নারী বা পুরুষেরা তৃতীয় লিঙ্গের না-নারী না-পুরুষদের আজব প্রাণী হিসাবে দেখিয়াছেন। অকারণ পথেঘাটে তাঁহাদের ঠাট্টাতামাশা করিয়াছেন। কুত্‌সিত ইঙ্গিত ছুড়িয়া দিয়াছেন। দীর্ঘদিন ধরিয়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা বৈষম্যের শিকার হইয়াছেন। এই বৈষম্য দূর করিতেই তাই বৃহন্নলাদের জন্য বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা। যেমন তফসিলি জাতি, জনজাতিদের জন্য, সেই রূপ। ইহা মানিতেই হইবে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা এত দিন অবধি বৈষম্যের শিকার। কিন্তু ইহার হাত হইতে বাঁচিবার উপায় কি সংরক্ষণ? সংরক্ষণ চালু করিলে কি রাতারাতি সমাজমন বদলাইয়া যাইবে? অভিজ্ঞতা বলিতেছে, যাইবে না। তফসিলি জাতি ও জনজাতির জন্য সংরক্ষণ চালু করিবার ফলে অনেক সময়েই সাধারণের সহিত তাঁহাদের ভেদ গড়িয়া উঠিয়াছে। প্রতি মুহূর্তে যেন মনে করাইয়া দেওয়া হইতেছে: তুমি পশ্চাত্‌পদ, তাই সংরক্ষণের সুবিধা ও তাবিজপ্রাপ্ত। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি এমনিতেই সমাজের একাংশের মনে স্বাভাবিক সমানুভূতি নাই। সংরক্ষণ চালু করিলে এই দূরত্ব বৃদ্ধি পাইবে। সমাজমনের পরিবর্তন হইবে, সেই আশা নাই।

সংরক্ষণ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই মতামত সম্পর্কে অন্য একটি প্রশ্নও উঠিতে পারে। নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা সর্বোচ্চ আদালতের কর্তব্য। তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি প্রদান করিয়া মানুষের অধিকার নিশ্চিত করিল আদালত। কিন্তু সেই অধিকার প্রসারের কাজ সরকারের, সমাজের। সমাজের দায়িত্ব মনের অন্ধকার দূর করা। আদালত এই ক্ষেত্রগুলিতে প্রবেশ না করাই বাঞ্ছনীয়। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত কিছু দিন পূর্বে সমকামীদের যৌনাচারকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করিবার বিষয়ে প্রচলিত আইন রদ করিতে রাজি হয় নাই, সেই দায়িত্ব আইনসভার উপর ছাড়িয়া দিয়াছে। সে ক্ষেত্রে হয়তো সুপ্রিম কোর্ট আপন এক্তিয়ার সম্বন্ধে কিছুটা বেশি মাত্রায় রক্ষণশীলতার পরিচয় দিয়াছে। হয়তো আদালতের সে ক্ষেত্রে মানবিক অধিকার রক্ষার্থে আর একটু দৃঢ় হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বৃহন্নলাদের ক্ষেত্রে আবার আদালত আগাইয়া আসিয়া সংরক্ষণের প্রসঙ্গ তুলিল। এই দুই অবস্থানের মধ্যে কিছুটা অসামঞ্জস্য আছে কি না, সে প্রশ্নও অপ্রাসঙ্গিক নয়। তৃতীয় লিঙ্গ স্বীকৃতি পান, পুঞ্জীভূত বঞ্চনার প্রতিকার হউক। কিন্তু কী উপায়ে, তাহা স্থির করিবার ভার সরকার এবং সমাজের উপর ছাড়িয়া দেওয়াই বিধেয় নয় কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE