Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ

তৃতীয়ের সন্ধানে: ক্ষমতা, মমতা, না সমতা?

দাদাঠাকুর (শরৎচন্দ্র পণ্ডিত) পালাকীর্তনের স্টাইলে ভোটের গান লিখেছিলেন। ‘আমি ভোটের লাগিয়া ভিখারী সাজিনু/ ফিরিনু গো দ্বারে দ্বারে।’ তাতে আবার আখর দিতে হত। ‘আমি ভিখারী না শিকারী গো!’ ‘আমি নেতা কি অভিনেতা, আহা মালুম করিবে কে তা?’ রোমান সেনেট থেকে ওয়াশিংটন ডিসি, তথা দিল্লির সংসদ ভবন পর্যন্ত সর্বত্রই, সর্বকালেই ভাল-মন্দ ব্যর্থ-সফল উদীয়মান-অস্তমান সব নেতাকেই অভিনয় করতে হয়।

নৈতিকতার দর্শন। (বাঁ দিকে, ওপর থেকে) ইমানুয়েল কান্ট ও মিশেল ফুকো; (ডান দিকে) মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী।

নৈতিকতার দর্শন। (বাঁ দিকে, ওপর থেকে) ইমানুয়েল কান্ট ও মিশেল ফুকো; (ডান দিকে) মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী।

অরিন্দম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

দাদাঠাকুর (শরৎচন্দ্র পণ্ডিত) পালাকীর্তনের স্টাইলে ভোটের গান লিখেছিলেন। ‘আমি ভোটের লাগিয়া ভিখারী সাজিনু/ ফিরিনু গো দ্বারে দ্বারে।’ তাতে আবার আখর দিতে হত। ‘আমি ভিখারী না শিকারী গো!’ ‘আমি নেতা কি অভিনেতা, আহা মালুম করিবে কে তা?’ রোমান সেনেট থেকে ওয়াশিংটন ডিসি, তথা দিল্লির সংসদ ভবন পর্যন্ত সর্বত্রই, সর্বকালেই ভাল-মন্দ ব্যর্থ-সফল উদীয়মান-অস্তমান সব নেতাকেই অভিনয় করতে হয়। শুধু এই কারণে নয় যে, রাজনীতি করতে গেলে দরকার লজিক নয় রেটরিক, সত্যনির্ণয় নয় জনমনজয়কারী মতপ্রতিষ্ঠা, যাকে সাদা বাংলায় বলে পারসুয়েশন। নেতাকে অভিনেতা হতেই হয় শুধু এই কারণেও নয় যে রাজনীতি মানেই কূটনীতি। আর কূটনীতি মানেই ছলবলকৌশল। আমি পলিটিক্স বলতে যা বুঝি, তাকে পঞ্চ ‘প’-কার দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করে থাকি। প্লুরালিটি, পাওয়ার, প্রোটেস্ট, পলিসি এবং প্রগ্রেস। সৎরাজনীতির মূলে তাই থাকে একটিই বাংলা প-শব্দ: ‘পরার্থপরতা’। এখন, স্বার্থ বা স্বপরিবার, স্বগোষ্ঠী, স্বদলের স্বার্থকে অতিক্রম করে, কখনও বা তার বিরুদ্ধে গিয়ে পরস্পর বিবদমান ‘পরের’ স্বার্থে কাজ করতে গেলে প্রথমেই দরকার হয় এক রকমের নাটকীয় কল্পনাশক্তির। আমি যখন মঞ্চের ওপরে বরমাল্যের স্তূপ গলায় নিয়ে গলা ফাটিয়ে ময়দান গরম করা বক্তৃতা দিচ্ছি, সে সময় এক জন তিতিবিরক্ত অটোরিকশা চালক আমাকে চড় মারবার আগে কী কী আবেগে আলোড়িত হতে পারে তা কল্পনা করার জন্য যে কোনও সহৃদয় মানুষকে যে চিন্তানাটক করতে হয়, তাকে আজকালকার কগ্নিটিভ সায়েন্সে বলে ‘সিমুলেশন’। শেক্সপিয়র এবং গাঁধী এই নাটকে ঠিক ততটাই দক্ষ ছিলেন, যতটা ছিলেন ব্রেখ্ট বা বাদল সরকার। শুধু বাংলার গ্রাম থেকে ‘টাটা’ বাই বাই প্রত্যাখ্যাত আদর্শবাদী শিল্পপতির মনের ভাব কল্পনা করা নয়, সর্বনিম্ন আয়ের যে দুই হিন্দু ও মুসলমান, ব্রাহ্মণপুরুষ রিকশাচালক ও দলিত মহিলা প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা— পরস্পরের বিপরীত দাবি ও অভিযোগ নিয়ে আমার নির্বাচনী সভা বয়কট করে সবার অলক্ষ্যে মনে মনে আমাকে ধিক্কার দিচ্ছে, তার জায়গায় আমি থাকলে কী করতাম, সেটা শুধু কথায় বা মন্থর-বন্দুকে (মাপ করবেন, ‘স্লোগান’-এর এই সস্তা শ্লেষাত্মক অনুবাদের লোভ সামলাতে পারলাম না) নয়, ভেতরে ভেতরে টের পাওয়ার জন্য হাড়েমজ্জায় ‘নট’ হতে হয়। কাজেই অভিনেতা না হয়ে বহু জনের নেতা হওয়া যায় না। একটি বড়সড় পরিবারের কর্ত্রী (যেমন রাসসুন্দরী দাসী ছিলেন উনিশ শতকের শুরুতে) হলে যেমন ভেতরটা ক্রমাগত অনেক ভাগে ভাগ হয়ে নিজের সঙ্গে নিজে যুঝতে যুঝতে চৌচির হতে থাকে, প্রজাতন্ত্রের সমর্থ জনপ্রতিনিধিকেও তেমনই ‘এক আমি, বহু সেজে দেখি কেমন লাগে’— এ রকম নাটক করেই অপমানে সবার সমান হওয়ার চেষ্টা করতে হয়। পরার্থপরতার এ রকম নাটক করতে করতেই সৎ-তার্কিক পলিটিশিয়ান দেশনায়কের ভেতরকার যশ ও ক্ষমতালোভী অহংকারের মৌরসি পাট্টা একটু একটু করে ক্ষয় হতে থাকে। ‘সৎ-তার্কিক’ কথাটা আমার বানানো নয়। ‘তন্ত্রালোক’ নামে ওঁর ম্যাগনাম্ ওপাস-এ অভিনবগুপ্ত সৎতর্ককে বলেছেন সর্বোত্তম যোগাঙ্গ। যার ভেতরে নিজের গোঁড়ামি ও স্বার্থান্ধতাকে খণ্ডন করে নিজের ভেতরেই পরের মতসংঘর্ষ অনুভব করে তর্ক করার ক্ষমতা আছে— তাকে প্রাণায়াম, ধ্যানধারণা করতে হয় না, মাত্র সৎতর্কের দ্বারাই সে সমরস যোগ বা ‘সমত্ব’ অবস্থা লাভ করতে পারে। তবে কিনা ভোটের বাজারে এ সব যোগফোগের কথা তোলাটা কি একটু অপ্রাসঙ্গিক হচ্ছে না? এই আত্মবিতর্কে ফিরে আসব এই লেখার শেষে।

গত লোকসভা ইলেকশনের একখানা ছবি ইন্টারনেটে মাঝে মাঝে দেখতে পাই। উটের ওপর চড়ে রাজস্থানের হতদরিদ্র গ্রামবাসীরা ভোট দিতে যাচ্ছেন। আবার হাতির পিঠে করে ইলেকট্রনিক ভোটগণনা যন্ত্র প্রত্যন্ত জঙ্গলমহলে পৌঁছে যাচ্ছে। এ সব ভারতবাসীর পক্ষে গর্ববাহী ছবি। যেন ভারতের পশুসমাজও গণতন্ত্রে সহায়তা করতে উন্মুখ! ১০ এপ্রিলের খবর, চণ্ডীগড়ে ভোট দেওয়ার শতকরা হার চুয়াত্তর ছাড়িয়ে গিয়েছে। বিশেষত দুনিয়াকে গণতন্ত্র (‘গ’ স্থলে ‘ধ’ পড়ুন) শেখানোর জন্য যে মার্কিন দেশ তক্ভিলের সময় থেকে জর্জ বুশের সময় পর্যন্ত এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকায় মোড়লি করে চলেছে, এবং আত্মবিজ্ঞাপনে জগতের মুখ ঢেকে ফেলছে, সে দেশের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক মানুষ ভোট দিতেই যায় না। সে দেশে বসে এই ছবি দেখে নিতান্ত নিরেট এনারাইদেরও একটু সখেদ অহংকার হওয়া উচিত।

পক্ষান্তরে দেড় দশক, মানে তিনটি নির্বাচন আগে, কোনও বাংলা খবরের কাগজে একটি ছোট মর্মন্তুদ খবর পড়েছিলাম, যে খবরটাকে একটা রূপক হিসেবে দেখলে পৃথিবীর ‘বৃহত্তম গণতন্ত্রের’ এই বড়াইবেলুন একেবারে চুপসে যায়। কোনও স্থানীয় আদিবাসী নেতা তরুণকে ভোটের দিন দুয়েক আগে দুটি বিরোধী দলের পার্টি অফিসে ডেকে এনে এমন আকণ্ঠ মদ্যপান করানো হয়েছিল যে সে অ্যালকোহল-বিষাক্ত হয়ে ভোটের দিন সকালেই মারা যায়। বুরিডানের ক্ষুধার্ত গাধা দু’দিকে সমান দূরত্বে সমান লোভনীয় সমপরিমাণ ভোজ্যদ্রব্যের মাঝখানে দোটানায় পড়ে উপবাসে মারা গিয়েছিল। এই গ্রাম্য নেতাটির হাতে ছিল একটা পাইকারি গোষ্ঠীভোটের চাবি। বেচারা বিবদমান উভয় দলের অতিদাক্ষিণ্যে আক্ষরিক ভাবেই মাঠে মারা গিয়েছিল।

যদি সে সময় এই দুই দলেরই শত্রু কোনও তৃতীয় আদর্শবাদী পার্টি ‘ভোটের আগে জনগণকে মদ, টাকা অথবা প্রতিশ্রুতি ঘুষ দেওয়াটা ভ্রষ্টাচার’ এই নৈতিক জিগির তুলত, তা হলে ওই গজবাহন ভোটগণক যন্ত্রগুলির চোখবাঁধা ‘ন্যায়’বিচারের গণনাতেও সেই তৃতীয় পক্ষের পরাজয়ই অবধারিত হত। স্বয়ং মহাভারতই এক্স্ট্রিমিজ্মের পক্ষে ঝোল টেনে সাবধান করেছেন, ‘অন্ত্যস্থা সুখমেধন্তে, ক্লিশ্যন্ত্যন্তরিতা জনাঃ।’ মাঝখানে থাকাটা বিপজ্জনক।

মধ্যমমার্গী আমি কিন্তু বলব যে, জনতা যদি বা সংখ্যাতাত্ত্বিক জ্যোতিষীদের ভবিষ্যৎবাণীতে মুগ্ধ হয়ে মুদ্রা আর মুদ্রণযন্ত্রের গাঁটবন্ধনের ক্ষমতায় শক্তিমান দুই দলের এক দলকেই জিতিয়ে দেয়— যাকে হাত দিয়ে জয়মালা দিতে পারল না, সেই পরাজিত কর্ণের দিকেও অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকতে পারে। এই মুহূর্তে দেশের কোথায় কারা বস্তুত জিতছে, সেই ভবিষ্যৎ ঘটনার ভিত্তিতে গড়-আন্দাজি প্রেডিকশন-কেই প্রেসক্রিপশন মনে করে আমরা যদি আবহাওয়া-মুরগির মতো বাস্তব ‘সাফল্য’কেই যোগ্যতার মাপকাঠি করি, তা হলে মহা ভুল করা হবে। রাজনীতি আর নৈতিকতাকে মেশাতে বারণ করেছেন দার্শনিক, ধর্মগুরু আর সমাজবিজ্ঞানী সকলেই। কিন্তু ভোটে শেষ পর্যন্ত যে জিতবে, বা জিতেছিল বা জিতছে, সে-ই যে অতএব জেতার যোগ্য তা কারওরই মনে করার কোনও কারণ নেই।

‘আমরা সবাই রাজা’ শুনতে ভাল লাগলেও আমরা কিছু দিন আগেই দেখেছি সাক্ষাৎ গণতন্ত্রের প্রাত্যহিক দেওয়ান-ই-‘আম’ কেমন করে দীর্ঘ দিনের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার প্রশাসনের সঙ্গে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালায়। বাকি পড়ে থাকে পরোক্ষ অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের রাস্তা। কিন্তু হব্স থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত সবাই যা নিয়ে চিন্তা করে কুল পাচ্ছেন না, তা হল, ‘যে রাষ্ট্রে প্রজারাই (প্রতিনিধির মাধ্যমে) রাজা— কেউ দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে বাঁধা নয়, সে রাজ্যে শাসিত কারা?’ সত্যিই কি ‘সর্বসাধারণ’ এই রকমের ‘স্বরাজের’ জন্য প্রস্তুত অথবা আগ্রহী? দু-আড়াই মাসের পরীক্ষাতেই রাজধানীর আপামর জনগণ বুঝে গেলেন যে সে জাতীয় লোকপালিত সমাজ বংশানুক্রমিক ক্ষমতার রাহুগ্রস্ত অথবা বৃহৎবাণিজ্যের সিঙ্গাপুরী উন্নয়নগন্ধে আমোদিত না হলে সেটা নৈরাজ্য বা অরাজকতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। দরকার হলে নাতসিদের সাহায্য নিয়েও যে দেশভক্তরা এক কালে ‘স্বাধীনতা’ চেয়েছিলেন, তাঁরা নৈরাজ্যের ভয় দেখিয়ে নিরোর স্বৈরাচারী রাজত্ব ভারতবাসীর ওপর চাপিয়ে দিতে চাইবেন। কিন্তু সেলুকাস! বড় বিচিত্র এই দেশ তা সইবে বলে মনে হয় না। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘প্রজা ও তন্ত্র’ বইতে অসামান্য স্বচ্ছতার সঙ্গে দেখিয়েছেন যে গোড়ায় গলদ আছে ‘প্রতিনিধিত্ব’-এর ধারণাটিরই মধ্যে। কে কার ‘হয়ে’ কথা বলতে পারে? অথচ প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতেই ভোটের রাজনীতি দাঁড়িয়ে থাকে অথবা চলিষ্ণু হয়ে আইন-প্রণয়ন, ন্যায়বিচার আর দণ্ডমুণ্ডের কর্তৃত্বপূর্বক শাসন এই ত্রিধা বিভক্ত ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে একটা দেশকে বাঁচিয়ে বাড়িয়ে নিয়ে চলতে পারে।

দুজনে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এলেও মহাত্মা গাঁধী এবং মিশেল ফুকো— উভয়েই ক্ষমতার বিরুদ্ধে অকপট এবং নির্ভয় সত্যকথনকে নাগরিকের কর্তব্য মনে করেছেন। কিন্তু সত্যকথনের জন্য চাই সত্যনির্ধারণ। সৌভাগ্যবশত পৃথিবীর অন্য অনেক গণতন্ত্রের আগে ভারতের গণতন্ত্রেই জনগণের তথ্যের অধিকারের ব্যাপারটা গণমাধ্যম এবং আইনের দৃষ্টিতে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে। আধুনিক পশ্চিমে, বিশেষত ৯/১১-র পরবর্তী আমেরিকায় সরকার ও কেন্দ্রীয় পুলিশ প্রজাসাধারণের ব্যক্তিগত জীবনের সব খুঁটিনাটির ওপরে এক সর্বদৃক্ গোয়েন্দাগিরি করতে পারে। রাষ্ট্রের একতরফা আধিপত্যের ও দণ্ডদান ক্ষমতার উৎস হল তার এই সর্বতশ্চক্ষুঃ প্যানপ্টিকন্। ভারতবর্ষে এমনকী অশিক্ষিত নরনারীও পশ্চিমি নাগরিকদের থেকেও বিপরীত ক্রমে শাসক ও সরকারের কাজকর্মের বিষয়েই সব জানতে চায়। এবং অনেকটা জানতে পারেও। বছর ছ’সাত আগে এক জন সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘তথ্যের প্রবল চাহিদা তৈরি হলে তবেই তথ্যের জোগান প্রসারিত ও অবাধ করার দাবিও জোরদার হয়।’ কোন শিল্পপতির ক’জন উপপত্নী আছে অথবা কোন মন্ত্রী ক’জন গুন্ডাকে গোপনে ড্রাগ বেচাকেনায় সুবিধা করে দিচ্ছেন সেই সব রসালো গোপন কথার লালসা শুধু নয়, খবর রাখা একটা গণতন্ত্রে দায়িত্ব নিয়ে বসবাস করার অপরিহার্য শর্ত। অন্যায় যে সহে সে যে রকম অন্যায়ের অংশত দায়িত্বভাক্ হয়, তেমনি আমরা ও সব পলিটিক্স-ফলিটিক্স বুঝি না— আমরা ‘কফি উইথ করণ্’ দেখতে ব্যস্ত থাকি বলে আমাদের অজান্তে দিল্লির দরবারে বা সংসদে কী করাপশন হচ্ছে সেই খবরের চাহিদা আমাদের নেই, এ কথা বলা মানে অন্যায় সওয়া। ভারতের উচ্চবিত্ত শিক্ষিত তরুণতরুণী সমাজে এ জাতীয় একটা অনীহা ছড়াচ্ছে এই মুহূতের্। কিন্তু অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। কেবল ‘তথ্য জানার দাবিতে আন্দোলন নয়, তথ্যের চাহিদা তৈরির আন্দোলন’ না গড়ে তুললে প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র ব্যর্থ হবেই।

অমর্ত্য সেন থেকে অনিতা অগ্নিহোত্রী পর্যন্ত অনেকেই ভারতের অন্যতম মুখ্য সমস্যা হিসেবে নারীর অপুষ্টি, নারীশিশুর মৃত্যুহার, এবং নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতন, পীড়ন, অবহেলা এবং পৌরুষ-দেখানো ধর্ষণের দিকে বার বার আমাদের নজর টেনেছেন। কিছু কিছু নারীবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অনেক ভেবেচিন্তে দাদাগিরির রাজনীতিকে নিপাতিত করে দরদি দিদিগিরির রাজনীতির একটা সক্ষম পরিমণ্ডল তৈরি করার কাজে ব্যাপৃত আছেন। দরদ ও সেবাযত্ন আজ পর্যন্ত মহিলা এবং অন্দরমহলের ব্যাপার হিসেবে আইন নিয়ন্ত্রিত পাবলিক স্ফিয়ারের বাইরে থেকে গিয়েছিল। যে দল হিন্দুত্ব নিয়ে লাঠালাঠি করে কয়েক দশক কাটিয়ে, এখন রাতারাতি জাতীয় আয় বৃদ্ধিকারী আন্তর্জাতিক বহুজাতিক বাণিজ্যের শিখর থেকে চুঁইয়ে পড়া উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি-প্যাকেজে নিজেদের ক্ষমতালোভী রাজনীতিকে ‘জনপ্রিয়’ করে তুলেছে, তাদের বিকল্প হিসেবে আমরা কি ওই আত্মত্যাগশীল সেবা-দরদের রাজনীতিকে এক বার চান্স দিয়ে দেখব? এমনকী নারীবাদী দার্শনিকরাও রাজা হঠিয়ে আবেগ পরিচালিতা গণসেবিকা রানিকে সিংহাসনে বসানোর আগে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে উপদেশ দেন। একে তো রয়েছে পিতৃসুলভ নিস্পৃহ ন্যায়বিচার বনাম মাতৃসুলভ দরদি পক্ষপাতিত্বের সমস্যা। মমতাভিত্তিক রাজনীতিতে স্বজনপোষণ ও বিতর্কের কণ্ঠরোধের সম্ভাবনা থাকে। গণতন্ত্রের শাসনে হৃদয়াবেগকে কতটা স্থান দেওয়া উচিত, এটা একটা গোলমেলে কিন্তু জরুরি প্রশ্ন। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা হল ‘পুরুষ মানেই রুটি রোজগেরে স্বার্থপর প্রতিশোধপরায়ণ কাজ হাসিল করা কখনও ক্ষমা না চাওয়া বজ্রধারী নর-ইন্দ্র’ আর নারীর কাজ হল মায়ের মতো বাৎসল্যে আত্মত্যাগে সহ্য করে যাওয়া, এই স্টিরিয়োটাইপ দুটি দরদের রাজনীতিতেও বজায় থেকে যেতে পারে।

পদ্মজা নাইডু, প্রতিভা পাটিল, জয়ললিতা— এঁদের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে আমরা কখনওই অমর্ত্য সেনের এই ‘সত্য যে কঠিন’কে অস্বীকার করতে পারব না যে, প্রত্যাশিত আয়ু এবং খাদ্যের লড়াইয়ে ভারতে আজও নারীরা পুরুষের কাছে পরাজিত। জাতের নামে বজ্জাতি হয়তো একটু একটু করে স্বাধীনতার পরে কমছিল কিন্তু গোটা নারীজাতিটাই ‘বদ্জাতি’— এ রকম একটা ধারণা এমনকী বিদেশে শিক্ষিত উচ্চবর্ণ হিন্দু বা মুসলমান থেকে শুরু করে দলিত পরিবারের অনেক পিতৃতান্ত্রিক অধিকারসচেতন অল্পবয়সিদের মধ্যেও গুপ্ত ভাবে কাজ করে বলে মনে হয়। অমর্ত্য সেন বলেছেন এই আত্ম-অতার্কিক ‘আধুনিক’ মাতৃত্বপূজারি মূল্যবোধ নারীর ওপর ‘সুবিচারের বদলে শ্রদ্ধার জন্ম দেয়। ওই মোহের উপর কোনও ন্যায়সংগত সমাজ নির্মাণ করা যায় না।’ গ্রামে, শহরে, হিন্দি ছবিতে আজও তাই শিবরাত্রি, তীজ, ব্রত, উপবাস ইত্যাদিতে ধার্মিক হিন্দুও মা-বোনেদেরই এগিয়ে দেয়। ভারতীয় প্রগ্রেসিভ পুরুষও স্বর্গাদপি গরীয়সী জননীজাতির সেবাযত্নের প্রত্যাশায় বা প্রত্যাহত প্রত্যাশায় জীবন কাটায়। প্রত্যাহত প্রত্যাশাই অন্ধ ক্রোধ ও মর্ষকাম হিসেবে ফুটে বেরোয়।

আজ যে ভাবে ভারতের ভোটদাতারা বিভ্রান্ত বোধ করছেন সেটা তবু ‘খারাপ লক্ষণ’ নয়, গণতন্ত্রের পক্ষে ‘ভাল’ লক্ষণ। মহামতি ইমানুয়েল কান্ট লিখেছেন, একটা সমাজ যখন নিজের ভেতরে বেশি বেশি দোষ, অন্যায়, অত্যাচার, ভ্রষ্টাচার, নৃশংসতা দেখতে পেয়ে আত্মসমালোচনায় সোচ্চার হয়ে ওঠে তখন— হয়তো যুদ্ধবাজিতে বা ধনবৃদ্ধিতে— তা দুর্বল হতে পারে, কিন্তু সমাজ হিসেবে তা সুস্থতরই হচ্ছে বুঝতে হবে। শহরে উলঙ্গ অপচয়বিলাসী ঐশ্বর্যের পাশাপাশি গ্রামে এবং ওই সব শহরেই উৎকট দারিদ্র, গৃহহীনতা, অনাহার অপুষ্টির বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। যে আমেরিকার মুক্ত বাজারের প্রতিযোগিতার নকলে কল্যাণকারী রাষ্ট্রের ধারণাকে আমরা প্রায় আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছি সে দেশে কিন্তু ভোটের আগে মুখ্য দলনেতারা, তথা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা, খোলাখুলি বিতর্কে নামেন। চলচ্চিত্রে অস্কার পুরস্কার বিতরণ উৎসবের মতনই ওই প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটের অনুষ্ঠানও টিভিতে চোখ আটকিয়ে লক্ষ লক্ষ নাগরিকরা দেখেন ও তা নিয়ে সাংবাদিক সমাজবিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করেন। আমাদের ভোটভিখারি প্রধানমন্ত্রিত্বকামী নেতারা সামনাসামনি বিতর্কে নামুন। তাঁদের সেই বিতর্কসভায় ভোটদাতারা বিচারকের আসন নিয়ে গণমাধ্যমগুলির মধ্যে সৎতর্ক তৈরি করুন।

পুরোপুরি সমতা কখনওই আসবে না। যেমন শীর্ষেন্দু তাঁর ‘টাংকি সাফ’ গল্পে লিখেছেন, ‘কিছু গার্দা থেকেই যাবে।’ কিন্তু গীতায় বলা হয়েছে ‘সমত্বই যোগ’। রাজ্যাভিষেক আর বনবাসে, জয়ে আর পরাজয়ে সমবুদ্ধি থাকার কুশলতা সেই যোগেরই চেহারা। এই ডামাডোল নির্বাচনের নির্দয় আঘাতে আগামী দিনের ভারতভাগ্যবিধাতা সে-রকমই এক দল যোগযুক্তফ্রন্ট হবেন আশা করা যায়। যে দলের প্রচারযন্ত্রের ‘মালকোষ’ যত ডলার-ইউরো-সমৃদ্ধ সে দলই হয়তো বাস্তবে জিতবে, অথবা আধাজিতের ক্ষমতা মিলিয়েজুলিয়ে আরও পাঁচ বছরের জন্য (স্টিগলিট্স-এর ভাষায়) এক শতাংশের জন্য, এক শতাংশের দ্বারা, এক শতাংশের সুবিধাদায়ী সরকার গঠন করবে। কিন্তু ক্ষমতা ও মমতার দিকে নজর রেখেও আমাদের সমতার দিকেই এগোতে হবে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর এক দৈববাণীর মতো কবিতায় আমাদের বলেছিলেন, ‘বরং দ্বিমত হও আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়...’

এই ভোটমহোৎসবে সমতার জন্য আন্দোলন করতে গেলে আমাদের উচিত স্বাতন্ত্র, মমতা এবং সমতা— এই তিন দিকেই খেয়াল রাখা, আস্থা রাখা তৃতীয় বিদ্যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই, মানোয়া’য় দর্শনের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

arindam chakraborty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE