Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

দাগ রাখিলেন

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর আজ্ঞাবহ কর্মী? মন্ত্রীর নিকট জবাবদিহি ব্যতীত কি তিনি কোনও পদক্ষেপ করিতে পারেন না? কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে বুধবারের তাণ্ডব সম্পর্কে সুরঞ্জন দাস বৃহস্পতিবার জানাইয়া দিয়াছেন, শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ‘রিপোর্ট’ না দিয়া তিনি কিছু বলিতে অপারগ— এই কারণেই বুধবার তিনি কিছুই বলিতে পারেন নাই।

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর আজ্ঞাবহ কর্মী? মন্ত্রীর নিকট জবাবদিহি ব্যতীত কি তিনি কোনও পদক্ষেপ করিতে পারেন না? কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে বুধবারের তাণ্ডব সম্পর্কে সুরঞ্জন দাস বৃহস্পতিবার জানাইয়া দিয়াছেন, শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ‘রিপোর্ট’ না দিয়া তিনি কিছু বলিতে অপারগ— এই কারণেই বুধবার তিনি কিছুই বলিতে পারেন নাই। এই মন্তব্য কেবল তাঁহার নিজের সম্মান নষ্ট করে নাই, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাও ভূলু্ণ্ঠিত করিতেছে। রাজ্যে ইতিমধ্যেই উপাচার্য পদটি প্রহসনের বস্তু হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এ বার সেই প্রহসনের গায়ে সরকারি সিলমোহর লাগিল। উপাচার্য নিজেই বুঝাইয়া দিলেন, বিকাশ ভবনের দাস না হইলে এই পদের যোগ্য হওয়া যায় না। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনাধীন পশ্চিমবঙ্গের শতাধিক বৎসর আগেও বাংলার বিশেষ গৌরবের বস্তু ছিল। ভবিষ্যতেও তেমন থাকিবে, সাধারণ প্রত্যাশা ছিল এমনই। সুরঞ্জনবাবু যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়া গেলেন, তাহার পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ গরিমার পথ কণ্টকাকীর্ণ হইয়া গেল। তিনি জানাইয়া গেলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় আসলে একটি সরকারি দফতর মাত্র।

যে শিক্ষামন্ত্রীর মুখাপেক্ষী হিসাবে উপাচার্য নিজেকে দেখিয়া থাকেন, তিনি এই প্রসঙ্গে কী বলিবেন, কী বলিতে পারেন, তাহা লইয়া অনুমানের জন্য কোনও পুরস্কার চলে না। এই শিক্ষামন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক হইতে শুরু করিয়া গুন্ডা, সব কিছু গলাইতে সিদ্ধহস্ত। অন্যায় আক্রমণকারীদের হাতে শিক্ষকদের এলোপাথাড়ি মার খাইতে দেখিয়াও কেবলই ‘শিক্ষকরা কেন আন্দোলন করিবেন’ এই ‘মূল’ প্রশ্ন তুলিতে তিনি ব্যতিব্যস্ত। দুর্বৃত্ত ছাত্রনেতাদের বিষয়ে তাঁহার দরদ উথলাইয়া রাজ্যে নৈরাজ্যের বান বহাইয়া দেয়। সুতরাং তিনি কোন পক্ষ অবলম্বন করিবেন তাহা জানিতে তথ্য, তত্ত্ব, গবেষণা অপ্রয়োজনীয়। কেবল শিক্ষামন্ত্রী কেন, রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় গোটা তৃণমূল সরকারের ভূমিকা বিষয়ে একটিও কথা খরচ করা অর্থহীন। তাঁহারা কেবল শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যের উত্তরাধিকার বহন করিতেছেন না, নৈরাজ্যকে তাঁহারা নূতন সংজ্ঞায় ভূষিত ও নূতন দুর্গন্ধে দূষিত করিতেছেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেই তো উপাচার্যের ভূমিকাটি আরও জরুরি হইবার কথা ছিল। তিনি দৃঢ় ভাবে নিজের পদটির ও প্রতিষ্ঠানটির সম্মানরক্ষায় সক্রিয় ও সরব হইলে ঘটনা এত দূর গড়াইত না।

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা যে দুর্নীতির সু়ড়ঙ্গে এ ভাবে তলাইয়া যাইতে পারে, তাহার জন্য কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায়দের অপেক্ষা সুরঞ্জন দাসদের দায়িত্বই অধিক। এই রাজ্যের রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীরা তো রাজনীতির স্বার্থ এবং দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণতর স্বার্থ ভিন্ন কিছু জানেন না। স্বার্থসিদ্ধির চুলচেরা হিসাব কষিয়া রাজ্যের বারোটা বাজাইয়া দিতে তাঁহাদের কিছুমাত্র দ্বিধা নাই। সুরঞ্জন দাসরা কিন্তু প্রত্যক্ষ রাজনীতির বাহিরের মানুষ। সমাজের একটি বিশিষ্ট অবস্থানে নেতৃত্বের উচ্চতায় তাঁহারা আছেন। চাহিলে এই ‘বারোটা’র ঘণ্টাটি তাঁহারা আটকাইতে পারিতেন। দলতন্ত্র ও সরকারতন্ত্রের চাপে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য ও অনাচার মাত্রাছাড়া হইলেও প্রতিষ্ঠানের নেতা-কর্তাদের যতটা ক্ষমতা, তাহা দিয়া তাঁহারা প্রতিষ্ঠানের ভাল-মন্দ, আচার-অনাচার নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিতেন। সেই প্রাতিষ্ঠানিক দায় ও দায়িত্ব পালনে সুরঞ্জনবাবু ব্যর্থ। ইতিহাসের ছাত্র ও গবেষক উপাচার্য মহাশয় নিশ্চয় জানেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে তো বটেই, বাংলার সামাজিক ইতিহাসেও এই ঘটনার গুরুত্ব কতখানি। তিনি ইতিহাসে দাগ রাখিয়া গেলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE