Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

দারুণ কিছু নয়, কিন্তু অন্য বিকল্প নেই

এ কথা নিশ্চয়ই বলা চলে না যে, নীতীশ কুমার এবং লালুপ্রসাদের জোটবন্ধন বিহারের পক্ষে এক পরম আশীর্বাদ। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির বিচারে রাজ্যে বিজেপির উত্থানের মোকাবিলায় আপাতত এ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। এবং, এই জোট হয়তো দিব্যি কাজও চালিয়ে দেবে।এ কথা নিশ্চয়ই বলা চলে না যে, নীতীশ কুমার এবং লালুপ্রসাদের জোটবন্ধন বিহারের পক্ষে এক পরম আশীর্বাদ। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির বিচারে রাজ্যে বিজেপির উত্থানের মোকাবিলায় আপাতত এ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। এবং, এই জোট হয়তো দিব্যি কাজও চালিয়ে দেবে।

অভিষেক চৌধুরি ও চিন্ময় কুমার
শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৪ ০০:১১
Share: Save:

সংবাদমাধ্যমের বিচারবিশ্লেষণ থেকে এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে, বিহারে নীতীশ কুমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার। গত বছর বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে তিনি যে বিরাট ভুল করেছেন, লোকসভা নির্বাচনে তার চড়া মাসুল দিতে হয়েছে। কিন্তু সমালোচকদের মতে, তাঁর ভুলের পালা সেখানেই শেষ হয়নি যে লালুপ্রসাদ তাঁর চরম শত্রু, তাঁর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে নীতীশ কুমার রাজনীতির মাঝমাঠে ফিরে আসার সমস্ত সম্ভাবনা জলাঞ্জলি দিয়েছেন। ২১ অগস্ট বিহারের দশটি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচনে নীতীশ কুমারের জেডি(ইউ) এবং লালুপ্রসাদের আরজেডি’র সঙ্গে কংগ্রেসও একজোট হয়ে লড়ছে বটে, তবে আলোচনা বা তর্কবিতর্ক যা হচ্ছে, তা প্রধানত প্রথম দুটি দলের জোট নিয়েই।

এই দু’দলই যে মরিয়া হয়ে হাত মিলিয়েছে, সেটা বোঝা কঠিন নয়। বিজেপি রামবিলাস পাসওয়ানের এলজেপি এবং উপেন্দ্র কুশবহার আরএলএসপি’র সঙ্গে জোট বাঁধার পরে বিহারে এনডিএ রীতিমত শক্তিশালী হয়েছে। উচ্চবর্ণের সমর্থন তো আগেই ছিল, এই শরিকদের কল্যাণে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ওবিসি, ইবিসি এবং দলিতদের ভোট। এই গোষ্ঠীগুলি আগে নীতীশ কুমার অথবা লালুপ্রসাদের সঙ্গে ছিল। স্বভাবতই তাঁরা বিপাকে পড়েছেন। তার ওপরে আছে তাঁদের দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। এই পরিস্থিতিতে বিজেপি-বিরোধী জোট এককাট্টা করার জন্য তাঁদের বাধ্য হয়েই জোট গড়তে হয়েছে, তা না হলে আসন্ন উপনির্বাচনে এবং আরও অনেক বেশি করে আগামী বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে লড়বেন কী করে?

এ পর্যন্ত গল্পটা ঠিক আছে। কিন্তু এর পরেই শুরু হয় কল্পকাহিনি। প্রথমত বলা হচ্ছে, নীতীশ তাঁর উন্নয়নের মঞ্চ ছেড়ে সেই পুরনো জাতপাতের রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছেন, ২০০৫-এর আগেকার জমানাতেই ফিরে গেছেন। ঘটনা হল, নীতীশ কোনও দিনই জাতপাতের গুরুত্ব অস্বীকার করেননি। বিজেপি’র সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার চালানোর সময় তিনি নিশ্চয়ই বিহারের প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে জোরদার করতে চেয়েছেন, রাজ্যের আর্থিক বৃদ্ধির উপর জোর দিয়েছেন, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে নতুন জাতপাতভিত্তিক জোট তৈরির চেষ্টাও চালিয়ে গেছেন। যেমন, পঞ্চায়েত স্তরে ইবিসি’র জন্য সংরক্ষণ, ‘মহাদলিত’ গোষ্ঠীর সৃষ্টি এবং তাদের জন্য নানা ধরনের কল্যাণ প্রকল্প, ইত্যাদি। আবার নানা উপলক্ষে তিনি উচ্চবর্ণকেও সন্তুষ্ট করতে তৎপর হয়েছেন, যেমন ভূমি সংস্কার বিষয়ে বন্দ্যোপাধ্যায় কমিটির সুপারিশ কার্যকর না করার সিদ্ধান্ত। সোজা কথাটা হল এই যে, জাতপাতের রাজনীতির সঙ্গে উন্নয়নের অনিবার্য কোনও বিরোধ নেই।

লালুপ্রসাদের বিরোধিতা করে যে জেডি(ইউ)-এর জন্ম, সে যখন আরজেডি’র সঙ্গে জোট বাঁধে, তখন সেই জোটকে একটা পশ্চাদ্মুখী রাজনীতি বলে সমালোচনা করার কারণ আছে। কিন্তু আদর্শ বা নীতির দিক থেকে দেখলে বিজেপির সঙ্গে নীতীশ কুমারের জোট বাঁধার সিদ্ধান্তটাই আরও বেশি সমস্যাসঙ্কুল ছিল। এই দুই দলের স্বার্থ এবং সমর্থনভিত্তি পরস্পরের সম্পূর্ণ বিপরীত। সতেরো বছর যে তারা একসঙ্গে ছিল, সেটাই একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। তার একটা কারণ ছিল এই যে, লালুপ্রসাদ উভয়েরই প্রতিপক্ষ, তাঁকে হারানোর জন্যই এই দুই পক্ষ নিজেদের আদর্শগত বিরোধ সরিয়ে রেখেছিল।

আর একটা প্রচার চলছে যে, নীতীশ এবং লালুর জোট বিহারে ‘গুন্ডা রাজ’ ফিরিয়ে আনবে। এখানে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, দুর্নীতি এবং অপরাধ আরজেডি’র চরিত্রগত, আর জেডি(ইউ) এবং বিজেপি দল নিশ্চয়ই হিসেবে অনেক পরিচ্ছন্ন, তা না হলে তারা আরজেডি’র তুলনায় ভাল প্রশাসন চালাতে পারত না। ঘটনা হল, জেডি(ইউ) এবং বিজেপি, দু’দলের কোনওটিতেই গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত সদস্যের সংখ্যা কোনও অংশে কম নয়। তাদের জোট সরকারের জমানায় নীতীশের দৃঢ় নেতৃত্বই গুন্ডাগিরিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। বিজেপির সঙ্গে জোটের ক্ষেত্রে নীতীশ কুমার যদি মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণে রেখে থাকতে পারেন, আরজেডি’র সঙ্গে জোটের ক্ষেত্রেও সেটা পারবেন, এমনটাই ধরে নেওয়া সঙ্গত নয় কি?

প্রশ্ন হল, জেডি(ইউ) এবং আরজেডি’র এই আকস্মিক এবং অস্বাভাবিক জোটকে ভোটদাতারা কী চোখে দেখছেন?

এটা মোটামুটি নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, এই নতুন জোট মুসলমান, যাদব এবং কুর্মি ভোট সংহত করতে পারবে। কিন্তু ইবিসি এবং মহাদলিতদের বিভিন্ন উপগোষ্ঠীর ভোটদাতারা কী করবেন, সেটা বলা কঠিন। আরজেডি জমানায় যাদবরা কিছু কিছু প্রান্তিক গোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন চালিয়েছিল, তারা এই জোটকে সমর্থন না-ও করতে পারে। তবে মুস্হর গোষ্ঠীর মহাদলিত নেতা জিতনরাম মাজিকে মুখ্যমন্ত্রী করে নীতীশ মহাদলিতদের সহানুভূতি অর্জন করতে চেয়েছেন, সেটা অনস্বীকার্য। মনে রাখতে হবে, বিহারের জনসংখ্যার প্রায় এগারো শতাংশ মহাদলিত।

সন্দেহ নেই, বিজেপি মাজি সরকারের প্রত্যেকটি ভুলভ্রান্তির সুযোগ নিতে তৎপর থাকবে, বলবে যে লালুপ্রসাদের ‘জঙ্গলের শাসন’ ফিরে এসেছে। এটাও নিশ্চিত যে, বিজেপি’র যত অন্তর্দ্বন্দ্বই থাক এবং রাজ্যে সুদৃঢ় নেতৃত্বের যতই অভাব থাক, বিহারের উচ্চবর্ণের মানুষ এনডিএ’কে সমর্থন করবেন। ইবিসি-মহাদলিত সমর্থন এনডিএ কতটা পাবে, বলা শক্ত। অবশ্য তারাও ইবিসি-মহাদলিতদের একটা পাল্টা জোট খাড়া করতে পারে।

জাতীয় স্তরে নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে উন্মাদনায় ইতিমধ্যেই ভাটার টান লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা কল্পনা করা কঠিন যে, এক বছরের মধ্যে তিনি এমন কিছু করতে পারবেন, যার ফলে বিহারের মানুষ বিপুল ভাবে বিজেপিকে ভোট দেবেন। একটা ব্যাপার এই প্রসঙ্গে লক্ষণীয়। বিহারকে বিশেষ বর্গের রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে বিজেপি আগে বিস্তর হইচই করলেও ক্ষমতায় আসার পরে এ বিষয়ে আশ্চর্য রকমের নীরব হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবারের উপনির্বাচনে জেডি(ইউ)-আরজেডি জোট কেমন করবে, সেটা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ, তবে সামনের বছর বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল সম্বন্ধে এই উপনির্বাচন থেকে যথেষ্ট আঁচ পাওয়া যাবে, এমনটা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। এক বছরে অনেক কিছুই বদলাতে পারে।

এ কথা নিশ্চয়ই বলা চলে না যে, নীতীশ কুমার এবং লালুপ্রসাদের জোটবন্ধন বিহারের পক্ষে এক পরম আশীর্বাদ। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির বিচারে রাজ্যে বিজেপির উত্থানের মোকাবিলায় আপাতত এ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প নেই। এবং, এই জোট হয়তো দিব্যি কাজ চালিয়ে দেবে।

চিন্ময় কুমার পটনায় ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার-এ অর্থনীতিবিদ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE