Advertisement
১৩ মে ২০২৪
সম্পাদকীয়

দ্রোহাভ্যাস

বাংলা সাহিত্যে এক সময়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রবল কৌলীন্য ছিল। প্রকৃত সাহিত্যিককে প্রতিষ্ঠানবিরোধীই হইতে হইবে— এই বাধ্যতায় অনেকে বিশ্বাস করিতেন। যে লেখকগণ কোনও প্রতিষ্ঠানের মদতে খ্যাত বা ধনী হইতেন, সাধারণ মানুষ তাঁহাদের লইয়া উত্তেজিত ও আপ্লুত থাকিলেও, চর্চাবান মহলে তাঁহাদের নিতান্ত মেরুদণ্ডহীন, লোভী ও আত্মবিক্রয়কারী জীব হিসাবে ধরা হইত। পাশাপাশি ইহাও ধরিয়া লওয়া হইত: তাঁহারা লেখক হিসাবেও ব্যর্থ। বিশ্বাস করা হইত, লেখকের কাম্য কেবল নিজ সাধনায় সিদ্ধি।

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৮
Share: Save:

বাংলা সাহিত্যে এক সময়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রবল কৌলীন্য ছিল। প্রকৃত সাহিত্যিককে প্রতিষ্ঠানবিরোধীই হইতে হইবে— এই বাধ্যতায় অনেকে বিশ্বাস করিতেন। যে লেখকগণ কোনও প্রতিষ্ঠানের মদতে খ্যাত বা ধনী হইতেন, সাধারণ মানুষ তাঁহাদের লইয়া উত্তেজিত ও আপ্লুত থাকিলেও, চর্চাবান মহলে তাঁহাদের নিতান্ত মেরুদণ্ডহীন, লোভী ও আত্মবিক্রয়কারী জীব হিসাবে ধরা হইত। পাশাপাশি ইহাও ধরিয়া লওয়া হইত: তাঁহারা লেখক হিসাবেও ব্যর্থ। বিশ্বাস করা হইত, লেখকের কাম্য কেবল নিজ সাধনায় সিদ্ধি। ‘সিদ্ধাই’য়ের দাপটে বিচ্যুত হইলে, বাড়ি-গাড়ির ফাঁদে জড়াইয়া পড়িলে, নিষ্কলুষ সংস্কৃতিযাপন সম্ভব নহে, আজ নহিলে কাল এই বস্তুগত স্বাচ্ছন্দ্যের খাজনা দিতে হইবে, আপন কাজটিকে তরল ও সরল করিয়া। জনপ্রিয়তার দায় ও সম্পদের আমোদ, লেখককে উৎকর্ষ ও স্বাতন্ত্র্যের পথ হইতে ছিন্ন করিয়া বাজার-বশ্যতার দরবারে আনিয়া ফেলিবে। রাজাকে তুষ্ট করিতে অভ্যস্ত ও ব্যস্ত সভাকবি, নিজের মতানুযায়ী কবিতা না লিখিয়া, রাজার রুচিমাফিক কাব্যরচনায় অভ্যস্ত হইয়া যাইবেন। জনপ্রিয়তায় প্রকৃত শিল্পের ক্ষতি হয়, জ্যা শিথিল হইয়া পড়ে, ইহাও অনেকেরই মত ছিল। যদিও এই মতামতের নেপথ্যে বহু সময় কাজ করিত ঈর্ষা, দ্বেষ, নিজে প্রতিষ্ঠানসিদ্ধ হইয়া উঠিতে না পারিবার আক্ষেপ, কিন্তু অনেক লেখকই এই উগ্র মতাবলম্বনের অগ্নি হইতে নিজ উত্তাপ ও অস্ত্র খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন। সহজ প্রতিষ্ঠার পথে, স্থূল জনপ্রিয়তার পথে কিছুতে হাঁটিব না— এই প্রতিজ্ঞা বাংলা সাহিত্যের কিছু লেখককে অতি মৌলিক ও স্পর্ধিত সাহিত্য রচনায় প্রণোদিত করিয়াছে। বৈপ্লবিক ভাবনা ও আশ্চর্য আঙ্গিক লইয়া ইঁহারা সাহিত্যপ্রয়াস লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। কেহ ‘কাল্ট’ হইয়াছেন, কেহ হন নাই, কিন্তু এই প্রকল্পগুলিই একটি ভাষা ও সংস্কৃতিকে আগাইয়া লইয়া যায়, কিছু লোক পাঁচিল ভাঙিতে গিয়া আহত হয় বলিয়াই বহু লোক উন্মুক্ত প্রান্তরে পদচারণার স্বাদ পাইয়া থাকে। সদ্যপ্রয়াত নবারুণ ভট্টাচার্য তাঁহার ঘোরতর প্রতিষ্ঠানবিরোধী স্বকীয়তায় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করিয়াছেন।

কিছু লেখকের সত্তায় নিহিত থাকে এক সদাবিদ্রোহী স্রোত, যাহা তাঁহাকে যে কোনও মূলস্রোতের বাহিরে থাকিতে, যে কোনও ক্ষমতার নিকটে না যাইতে শিক্ষা দেয়। ইহাতে তিনি সতত স্বাধীন থাকিতে পারেন। নীতিনিষ্ঠ থাকিবার নিরন্তর অধ্যবসায় ও অতিরিক্ত সাবধানতা তাঁহাকে কখনও হয়তো অপ্রয়োজনীয় প্রখর করিয়া দেয়, কিন্তু প্রচল-সরণিকে প্রত্যাখ্যানের চর্চা এতই কঠিন, ইহার জন্য প্রবল দহন ও দাহিকাশক্তির ব্যবহার আবশ্যক। বাংলার শতেক লিট্ল ম্যাগাজিন একদা এই সমান্তরাল বা মূলস্রোতবিরোধী সাহিত্যের নিশান সগর্বে বহন করিয়াছে। ছোট পত্রিকার নিজস্ব আইকন, ঘরানা, বিকল্প তত্ত্ববিশ্ব ও তর্কবিশ্ব তৈয়ারি হইয়াছে। এই প্রবণতার বিপদও রহিয়াছে: কেবল মূলস্রোতে থাকিবার লোভটি পরিহার করিতে পারিয়াছে বলিয়াই অধিকাংশ পত্রিকা ও লেখক এমন আত্মগুরুত্বে স্ফীত হইয়া পড়িতেন যে, তাঁহারাও নিজ সাধনার অধিক জরুরি মনে করিতেন নিজ প্রতিষ্ঠানবিরোধী পরিচয়টিকেই। ফলে তাঁহাদেরও সাহিত্যচর্চা নিতান্তই ব্যাহত হইত, লেখা অপেক্ষা বিষোদ্গার ও শিবিরস্থাপন করিবার প্রতি অধিক মনোযোগ ও আত্মপ্রয়োগ ধাবিত হইত। প্রতিষ্ঠানের সকল লেখককেই— লেখার মান ও ভাবনাভঙ্গি নির্বিশেষে— পরিত্যাজ্য ও অপাঠ্য বলিয়া দাগিয়া দিবার একদেশদের্শিতা ও সাম্প্রদায়িকতার দোষও অধিকাংশের স্কন্ধেই ভর করিত। তিক্ততার ভাগ অধিক হইয়া পড়িলে কোনও সৃষ্টিই ফলবতী হয় না। আজ এই আন্দোলন তাহার জ্যোতি বহুল পরিমাণে হারাইয়াছে। চতুর্দিকে বাজারের নিরঙ্কুশ জয় ও নিজভূমে প্রতিভার অভাব তাহার মূল কারণ। নবারুণের ন্যায় শক্তিশালী লেখকের প্রয়াণ বাংলার এই দ্রোহসংস্কৃতিকে আরও স্তিমিত করিবে।

য ৎ কি ঞ্চি ৎ

দিল্লিতে ভিভিআইপি জোন-এ বাঁদরের উপদ্রবে সবাই নাজেহাল, তাই নয়াদিল্লি পুরসভার নির্দেশে জনাচল্লিশেক মানুষ হনুমান সেজে উৎকট আওয়াজ করে ও লাফিয়েঝাঁপিয়ে বাঁদরদের ভয় দেখাতে নেমে পড়লেন। প্রজেক্ট দুর্দান্ত সফল। স্বাভাবিক। মার্ক্স দিয়ে গিয়েছেন ‘ডি-ক্লাস্ড’ হওয়ার উপদেশ। বাঁদর থেকে আমরা মানুষ হয়েছি, দরকার পড়লে মানুষ থেকে বাঁদর হতে পারব না? বাঁদরের চেয়েও ভাল বাঁদরামি যখন-তখন পারি, তা নইলে কীসের সুপিরিয়র স্পিশিস?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE