Advertisement
১১ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

দায়

মর্মান্তিক দুর্ঘটনা? মর্মান্তিক নিশ্চয়ই, কিন্তু মাউন্ট এভারেস্টের পথে যাহা ঘটিয়াছে তাহাকে দুর্ঘটনা বলিলে কথা ফুরায়, সংশয় ফুরায় না। প্রথম প্রশ্ন: যাঁহারা ভূপৃষ্ঠের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে উঠিতে গিয়া প্রাণ হারাইয়াছেন অথবা এখনও নিখোঁজ, তাঁহারা শারীরিক ও মানসিক ভাবে যথেষ্ট প্রস্তুত ছিলেন কি? তাঁহাদের ইচ্ছা বা তাগিদের সততা লইয়া প্রশ্ন নাই।

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৬ ০০:২৩
Share: Save:

মর্মান্তিক দুর্ঘটনা? মর্মান্তিক নিশ্চয়ই, কিন্তু মাউন্ট এভারেস্টের পথে যাহা ঘটিয়াছে তাহাকে দুর্ঘটনা বলিলে কথা ফুরায়, সংশয় ফুরায় না। প্রথম প্রশ্ন: যাঁহারা ভূপৃষ্ঠের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গে উঠিতে গিয়া প্রাণ হারাইয়াছেন অথবা এখনও নিখোঁজ, তাঁহারা শারীরিক ও মানসিক ভাবে যথেষ্ট প্রস্তুত ছিলেন কি? তাঁহাদের ইচ্ছা বা তাগিদের সততা লইয়া প্রশ্ন নাই। কিন্তু এমন অভিযানে ইচ্ছা ও তাগিদের উপর যাহা অপরিহার্য, তাহার নাম সামর্থ্য, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন। তিনটি বিষয় স্বতন্ত্র, কিন্তু বিচ্ছিন্ন নহে। নিজস্ব শারীরিক সামর্থ্য ন্যূনতম মাত্রায় থাকা জরুরি বটে, কিন্তু তাহার পরে প্রয়োজন হয় যথেষ্ট প্রশিক্ষণের, এবং ধারাবাহিক ও পর্যাপ্ত অনুশীলনের। বিশেষত, এভারেস্টের মতো শৃঙ্গে আরোহণের আগে তুলনায় খাটো কিন্তু যথেষ্ট উঁচু কয়েকটি শৃঙ্গ জয়ের অভিজ্ঞতা স্বাভাবিক কারণেই আবশ্যক। যেমন, ৮০০০ মিটারের ঊর্ধ্বে যে ১৪টি শৃঙ্গ আছে, সেগুলি জয় করিবার আগে ৭০০০ মিটারের বেশি উঁচু একাধিক শৃঙ্গ জয়ের অভিজ্ঞতা অনুশীলন হিসাবেই গুরুত্বপূর্ণ। ইহা একটি দৃষ্টান্তমাত্র, ষোলো আনা প্রস্তুতির বহু শর্ত থাকে। সেগুলি সম্পূর্ণ পূরণ না করিয়া, শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য বিষয়ে যথেষ্ট নিশ্চিত না থাকিয়া গ্রহের শিখরে চড়িবার সাহস দুঃসাহসের শামিল।

সাহস এবং দুঃসাহসের পার্থক্যটি কালক্রমে কমিয়াছে। পাঁচ দশক আগে বছরে মাত্র কয়েক জন এভারেস্ট অভিযান করিতেন, এখন বার্ষিক সংখ্যা কয়েকশো। আক্ষরিক অর্থেই পথে যাত্রী-জট জমিয়া যায়। এ বিষয়ে অনেক অভিযাত্রী ও পরিবেশবিদ ক্রমাগত সতর্কবাণী ঘোষণা করিয়া আসিতেছেন, অন্যতম পথিকৃৎ এডমন্ড হিলারি এই শৃঙ্গটিকে কিছু দিন ‘বিশ্রাম’ দিবার পরামর্শও দিয়াছেন, কিন্তু কেহ শোনে নাই। আরও নির্দিষ্ট করিয়া বলিলে, নেপালের পর্বতারোহণ সংস্থা শোনে নাই, ইচ্ছুক অভিযাত্রীদের দরাজ হাতে অনুমোদন দিয়া আসিয়াছে, পৃথিবীর শিখরে ভিড় বাড়িয়াছে। এভারেস্ট অভিযান তাহার বড় আয়ের উৎস, সুতরাং ঢালাও অনুমোদনের কারণটি দুর্বোধ্য নয়। পাশাপাশি, সে দেশের উদ্যোগীরা পশ্চিমী সংস্থাগুলির তুলনায় অর্ধেক খরচে এভারেস্ট অভিযানের ব্যবস্থা করিতেছে। খরচ কমাইবার সঙ্গে পরিষেবার মান নামাইবার সম্পর্ক সচরাচর প্রবল, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বে। তাহার উপর গত দুই বছর প্রাকৃতিক কারণে অভিযান বন্ধ থাকায় এ বার ভিড় আরও বেশি। এই পরিস্থিতিতে প্রস্তুতি এবং সতর্কতা মার খাইবার সম্ভাবনা স্বভাবতই প্রবল। সুতরাং দুর্ঘটনা ভয়াবহ, কিন্তু অপ্রত্যাশিত বলা শক্ত।

যথেষ্ট প্রস্তুতি ছাড়াই এবং পরিকাঠামো সম্পর্কে নিশ্চিত না হইয়াই যাঁহারা অভিযানের ঝুঁকি লইতেছেন, তাঁহাদের সচেতনতা বৃদ্ধির দায় বহুলাংশেই তাঁহাদের ব্যক্তিগত। কিন্তু যে সব পর্বতারোহী সংগঠন অভিযানের উদ্যোক্তা, তাহারা দায়ভাগ অস্বীকার করিতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে সরকারের দায়ও কম নয়, কারণ এ রাজ্যে পর্বতারোহীদের জন্য অনেক টাকা সরকারি অনুদান হিসাবে দেওয়া হয়। গত কিছু বছরে এ রাজ্যের অভিযাত্রীদের বেশ কয়েক জনের সাফল্য এ বিষয়ে উৎসাহ বাড়াইয়াছে। উৎসাহ এবং সতর্কতা প্রায়শই বিপরীতমুখী, বিশেষত বঙ্গভূমিতে, যেখানে যে কোনও বিষয়ে সতর্ক থাকিবার মানসিকতা বিরল বলিলে কম বলা হয়। ছন্দা গায়েনের স্মৃতি এখনও টাটকা, ইতিমধ্যেই নূতন বিপর্যয় ঘটিল। পাহাড় ক্রমাগত বিপদসংকেত পাঠাইয়া চলিয়াছে। শোনার দায় মানুষের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE