যুদ্ধ শেষ হয় নাই। যুদ্ধই বটে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাকে সরকারি লাগাম পরাইবার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। শিক্ষাক্ষেত্রে উৎকর্ষ বজায় রাখিবার, মুক্তচিন্তার পরিসরটি খোলা রাখিবার যুদ্ধ। আইআইএম-এর উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করিবার চেষ্টায় সরকার আপাতত এক পা পিছাইয়াছে। স্বেচ্ছায় নহে। দেশের সমস্ত আইআইএম যে ভঙ্গিতে আইআইএম বিল-এর বিরোধিতা করিয়াছে, তাহারই প্রতিক্রিয়া এই পশ্চাদপসরণ। কিন্তু, এই পিছাইয়া আসা যে নিজেদের ভুল বুঝিয়া নহে, তাহা স্পষ্ট। যতগুলি আপত্তি ছিল, তাহার সামান্যই সরকার মানিয়াছে। আপত্তির বাকি কারণগুলি বহাল। অর্থাৎ, সরকারের এই পশ্চাদপসরণ রণকৌশলমাত্র। নিয়ন্ত্রণ কায়েমের যুদ্ধ সরকার ছাড়ে নাই। যাঁহারা নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখিবার লড়াই লড়িতেছেন, তাঁহাদেরও রণক্ষেত্র ছাড়িবার উপায় নাই। বস্তুত, এখনই প্রত্যাঘাতের সেরা সময়। প্রতিরোধকে এমনই সুতীব্র করিয়া তোলা বিধেয়, যাহাতে এই বিক্ষোভ উদাহরণ হইয়া থাকে। ভবিষ্যতে কোনও সরকার যেন কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হস্তক্ষেপ করিবার পূর্বে বহু বার ভাবিতে বাধ্য হয়। শুধুমাত্র আইআইএম নহে, এই লড়াই ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা বজায় রাখিবার লড়াই হইয়া উঠুক।
সেই স্বাধীনতা সংগ্রাম যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই অপরিহার্যও বটে। এক্ষণে স্পষ্ট, কোনও প্রধানমন্ত্রী ন্যূনতম সরকারের প্রতিশ্রুতি দিন আর না-ই দিন, মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর নাম কপিল সিব্বলই হউক বা স্মৃতি ইরানি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা রাজনীতিকদের মজ্জাগত। কারণটি সহজ। হীরক রাজার ন্যায় তাঁহারাও বুঝিয়াছেন, জ্ঞানচর্চার পরিসরটি মুক্ত থাকিলে বিপজ্জনক প্রশ্নের সংখ্যা বাড়ে। পারিলে হয়তো তাঁহারাও পাঠশালা উঠাইয়া দিতেন। ততখানি সম্ভব নহে দেখিয়া লাগাম পরাইতে চাহেন। প্রশ্ন শুধু আইআইএম বা আইআইটি-র নহে। রাজনীতিকরা জ্ঞানচর্চার সকল প্রতিষ্ঠানকেই দখল করিতে চাহেন। আইসিএইচআর-এর উদাহরণটি স্মর্তব্য। এক বার নিয়ন্ত্রণ কায়েম হইলে যেমন ‘নিজের লোক’ বসানো সহজ হয়, তেমনই ‘দুষ্ট লোক’দের বিদায় করিতেও সমস্যা থাকে না। বস্তুত, যাঁহারা প্রকৃত জ্ঞানচর্চায় বিশ্বাসী, তাঁহারা রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত পরিসরকে এড়াইয়াই চলেন। কাজেই, প্রতিরোধের দায়িত্বও শুধু আইআইএম-এর ছাত্র-শিক্ষকদের নহে। দায়িত্ব ভারতের বিদ্বৎ-সমাজের। বৃহত্তর অর্থে, নাগরিক সমাজের। দেশের গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী-সাংস্কৃতিক চরিত্রটিকে বাঁচাইয়া রাখিতে হইলে, সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যের নিকট নতিস্বীকার না করিতে চাহিলে প্রত্যেককে এই লড়াইয়ে শামিল হইতে হইবে।
নাগরিক সমাজের ভূমিকা সংযোগকারীর। আইআইএম-এর প্রতিবাদ তাহার তীব্রতায় ব্যতিক্রমী, কিন্তু চরিত্রে নহে। ইতিমধ্যেই দেশের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আরম্ভ হইয়াছে। প্রতিরোধগুলি যাহাতে বিচ্ছিন্ন না থাকে, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে বৃহত্তর বিদ্বৎ-সমাজকেই। এই প্রতিরোধের চরিত্র এমনই যে সংযুক্ত হইতে থাকিলে তাহার ভার এবং ধার বহু গুণে বাড়ে। বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধগুলিকে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনে উত্তীর্ণ করিবার দায়িত্ব দেশের বিদ্বৎসমাজকে লইতে হইবে। মুক্ত চিন্তার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রবণতার বিরুদ্ধে আন্দোলন, মধ্যমেধার আধিপত্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আইআইএম-এর স্বশাসনের ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হইতেছে কি না, এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটিও এই বৃহত্তর প্রেক্ষিতে গৌণ বোধ হয়। ভারতে চিন্তার, চর্চার স্বাধীনতা থাকিবে কি না, তাহাই মুখ্য প্রশ্ন। সরকারের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy