Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

নতুন রাজনীতি: মানুষ তৈরি, কিন্তু দল?

আপ-কে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক দল হওয়ার জন্য আদর্শ ও বাস্তবের মধ্যে আপস-মীমাংসার কৃত্‌কৌশলের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রশান্ত ভূষণের ‘বিশুদ্ধ রাজনীতি’র উচ্চবর্গীয় আদর্শের থেকে ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্রের প্রশাসনিকতার অ্যাজেন্ডা পার্টির আয়ুষ্কালের জন্য অনেক বেশি কার্যকর।আপ-কে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক দল হওয়ার জন্য আদর্শ ও বাস্তবের মধ্যে আপস-মীমাংসার কৃত্‌কৌশলের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রশান্ত ভূষণের ‘বিশুদ্ধ রাজনীতি’র উচ্চবর্গীয় আদর্শের থেকে ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্রের প্রশাসনিকতার অ্যাজেন্ডা পার্টির আয়ুষ্কালের জন্য অনেক বেশি কার্যকর।

বাস্তববাদী। অরবিন্দ কেজরীবাল, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে সাংবাদিক বৈঠকে, দিল্লি, ২ জানুয়ারি।

বাস্তববাদী। অরবিন্দ কেজরীবাল, মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে সাংবাদিক বৈঠকে, দিল্লি, ২ জানুয়ারি।

মানস রায়
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৫২
Share: Save:

ক্ষমতায় আসার এক মাস পার হওয়ার আগেই আপ শীর্ষ নেতৃত্বের বিবাদ সংবাদপত্রের হেডলাইন হয়ে গেছে। অভিযোগ উঠেছে কেজরীবালের দল পরিচালনার স্টাইল নিয়ে, দলে তাঁর কেন্দ্রিকতা নিয়ে। বলা হচ্ছে, আপ এখন যে কোনও দশটা পার্টির মতো অস্বচ্ছ, অসত্‌, স্বৈরাচারী। কেজরীবাল ক্যাম্পের পাল্টা অভিযোগ, মিষ্টি-মসৃণ কথার আড়ালে যোগেন্দ্র যাদব ও প্রশান্ত ভূষণ আসলে ক্ষমতালোভী রাজনীতিক, যাঁরা কেজরীবালকে কোণঠাসা করার জন্য মরিয়া, এমনকী গত নির্বাচনে দলের খারাপ ফলের জন্য সচেষ্ট হতেও এরা কুণ্ঠিত হয়নি। এ সব খবর পড়ে অনেকের মতো আমিও হতাশ হয়েছি। কারণ দিল্লি শহর গত ১০ ফেব্রুয়ারি যা দেখেছিল, তা বসন্ত অভ্যুত্থানের কম কিছু নয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের বিচিত্র যাপনচিত্র, ধ্যানধারণা, জীবনচর্চার নানা অগ্রন্থিত ব্যাকরণ, সব যেন এসে মিশেছিল একটি দাবিতে: চাই দুর্নীতিহীন সদর্থক প্রশাসন। কিন্তুবাদীদের সব প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে দিল্লিবাসী সে দিন জাতিধর্মশ্রেণিনির্বিশেষে আপ-এর পক্ষে এমন উজাড় করে রায় দিলেন যে গোটা প্রতিপক্ষ প্রয়োজনে এক অটোতে বিধানসভা পৌঁছে যেতে পারবেন।

ভেবে দেখা যাক, রাজনৈতিক ক্রীড়াঙ্গনে আপ কী ধরনের নতুন খেলোয়াড় এবং তাদের নতুন রাজনীতির ধাঁচটাই বা কী। নয়া পুঁজি, তথা নিও-লিবারাল অর্থনীতির সঙ্গে তাদের যে খুব বেশি ঝগড়াঝাঁটি আছে, তা তো মনে হয় না। বিজেপি বা কংগ্রেসের মতো আপ-ও চায়, দিল্লিকে আজকের ‘ওয়ার্ল্ড সিটি’ বা বিশ্ববন্দিত শহর বানাতে। তাই গোলকায়নের অ্যাজেন্ডা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে আছে, তা কী করে বলি? জমি-বিল নিয়ে আপ যা-ই বলুক না কেন, দিল্লির প্রশাসনে তার প্রভাব কমই পড়বে, তা কেজরীবাল ভাল ভাবেই জানেন।

আপ কি তা হলে সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের আন্দোলন? আপ-এর নেতৃত্ব, কর্মী এবং অনেক সমর্থকই নাগরিক সমাজের শিক্ষিত, সফল মানুষ, কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আপ-এর ভোট মূলত এসেছে তাঁদের থেকে, সমাজে যাঁদের অবস্থান নাগরিক সমাজের বাইরে। রাষ্ট্র থেকে এই শ্রেণির মানুষ নিরাপত্তা পান না, বরং পুলিশ ও আইনের লম্বা হাত সামান্য ছুতোয় এঁদের নিয়মিত ভাবে নাস্তানাবুদ করতে ছাড়ে না। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত মেনে এঁদেরও প্রত্যেকের, আর সবার মতোই, একটি করে ভোট আছে, যার সুবাদে এঁদের সামাজিক ও আইনি প্রান্তিকতা হয়ে দাঁড়ায় এক জোরালো রাজনৈতিক হাতিয়ার। আর ঠিক এখানেই আপ-এর রাজনীতির নিশানা। তাদের বক্তব্য, দেশের সংবিধান ও কল্যাণকামী রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি মেনে এই শ্রেণির মানুষের যত্ন নেওয়া, দেখভাল করা হবে সরকারের প্রধান কর্তব্য, যা দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো কেউ করেনি। তাই দিল্লির গরিব মানুষের ভোট-ব্যাঙ্ক আপ-এর দিকে চলে এসেছে। এ জন্য অবশ্য আপ-এর শিক্ষিত, আদর্শবাদী তরুণ ক্যাডারদের মহল্লায় মহল্লায়, ঝুগ্গি-ঝুপড়িতে পড়ে থাকতে হয়েছে, গরিব মানুষকে বোঝাতে হয়েছে। আপ-এর রাজনীতি কোনও সাবঅলটার্ন রাজনীতি নয়। আপ-এর মধ্যবিত্ত ভোটারদের পক্ষে কেন্দ্রে মোদী, রাজ্যে (অর্থাত্‌ দিল্লিতে) কেজরীবাল মোটেই খারাপ চয়েস নয়। মোদী আয়বৃদ্ধি দেখবেন, আপ প্রাত্যহিক দুর্নীতিকে বাগে রাখবে।

দুর্নীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন গরিব মানুষ। আবার পেটের দায়ে অনেক সময় গরিব মানুষকেই আইনের সীমানা পেরিয়ে যেতে হয়। যেমন, যাঁরা হকারি করছেন বা দখলদারি জমিতে বসত করেন, যাঁরা ঠিকঠাক নথি ছাড়াই অটো চালাচ্ছেন বা বিনা টিকিটে সাতসকালে ট্রেন ধরে কাজে আসছেন। পুলিশের হপ্তাবাজির মতো লোভের কারণে দুর্নীতি এ নয়, স্রেফ বেঁচে থাকার তাগিদে। দারিদ্র, বেঁচে থাকার অধিকার, নাগরিকের দাবি ও দায়িত্ব এ সব প্রশ্নকে সামনে রেখেই আপ-এর মতো একটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র বা গরিব মানুষকে কাছাকাছি আসতে, একটা সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে, তাঁদের সুস্থ নাগরিক হয়ে উঠবার প্রয়াসকে সামনে রেখে তাঁদের ‘এনটাইট্লমেন্ট’ বা স্বত্বাধিকারের জন্য হকদারি করতে পারে। এই বোঝাপড়া, এই প্রয়াস দরিদ্র মানুষের কৌমের চরিত্রে আনবে নৈতিকতার জোর, যা রাষ্ট্রকে এক রকম বাধ্যই করবে বিধিসম্মত গণ্ডি পেরিয়ে এঁদের সাহায্য করতে। এ ভাবেই আধুনিক রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের হাজারো আচরণ, চর্চা, চালচলনকে পরিচালনা করে, একটা ঘরানায় ফেলার চেষ্টা করে। আমার ধারণা, আপ নানা মহল্লায় সভাসমিতি করে এটাই করার চেষ্টা করছে। আপ-এর উদ্দেশ্য জীবনমুখী প্রশাসনিক রাষ্ট্র। নিছক সস্তায় পাইয়ে দেওয়া ধোঁকা-রাজনীতি ভাবলে আপ-এর এক্সপেরিমেন্টকে ভুল বোঝা হবে। এই দফায় হয়তো আপ প্রশাসনের লিমিটকে চ্যালেঞ্জ করবে না, বরং প্রশাসনের গণ্ডিকে একটু একটু করে বাড়ানোর চেষ্টা করবে।

এক অর্থে দিল্লিই আপ-এর সেরা ঠিকানা। গরিব বসতিগুলো এখনও সেখানে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বগলদাবায় চলে যায়নি। এগুলোতে সাধারণত আঞ্চলিক কোনও রাজনৈতিক দাদার ছত্রছায়ায় থাকা স্থানীয় মাফিয়া খবরদারি করে। পাশাপাশি কলকাতা বা মুম্বইয়ের কথা ভাবা যাক। ধরুন ‘হোক কলরব’-এর শিক্ষিত অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা কোনও একটা রাজনৈতিক দল বানিয়ে কলকাতার বস্তিতে বস্তিতে ভোটের জন্য প্রচার চালাল। এদের চোখ-মুখের জিয়োগ্রাফি ঠিকঠাক থাকবে তো? বলা মুশকিল। মুম্বইতে শিবসেনা ও কলকাতায় তৃণমূল এটুকু অন্তত নিশ্চিত করবে, আপ-এর মতো কোনও পরীক্ষানিরীক্ষা যেন এ সব চত্বরে না হয়।

তা ছাড়া, আপ উঠে এসেছে স্বচ্ছ প্রশাসনের জন্য একটি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। আপ-এর নেতৃত্ব খুব সযত্নে, অনেক চেষ্টায় এই নাগরিক আন্দোলনের শিকড় দরিদ্র, খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। তুলনায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে কবি, সাহিত্যিক, অভিনেতা, অধ্যাপক, বিভিন্ন এনজিও-র কর্তাব্যক্তিদের পরিচালনায় মিটিং-মিছিলের যে আন্দোলন কলকাতায় এক সময় শুরু হয়েছিল, তাকে শহরের গরিব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কোনও উদ্যোগই নেই, এই নেতানেত্রীদের ছিল না। বরং এঁরা যে যার নৈতিক প্রোফাইলিং-এ ব্যস্ত ছিলেন।

আপ-নেতৃত্বের অন্তর্দ্বন্দ্ব কি কেবলই নেতাদের স্বার্থের সংঘাত, না রাজনৈতিক অবস্থানের ফারাক? যোগেন্দ্র যাদব বা প্রশান্ত ভূষণ দলে কেজরীবালের কেন্দ্রিকতা নিয়ে যে-প্রশ্ন তুলেছেন, তা নিশ্চয় বিজেপি বা কংগ্রেসের নেতারা নিজেদের দল সম্পর্কে তুলবেন না। আর দলে এই দুই নেতা একেবারে কমজোরি ছিলেন তা মনে করারও কারণ নেই। কিন্তু কেজরীবালের ক্যারিশমা চলে গেছে, তা ভাবারও কোনও কারণ নেই। গত মাসের অভাবনীয় জয় কিন্তু কেজরীবালকে সামনে রেখেই হয়েছিল। সঙ্গে ছিল উদ্যোগী ও বিচক্ষণ অসংখ্য ক্যাডার।

যোগেন লোহিয়াবাদী সমাজবিজ্ঞানী, প্রশান্ত পোড়খাওয়া আইনজ্ঞ। দলকে তাঁরা মুক্তমনা, ভাবনাচিন্তার পরিসর হিসেবে দেখতে চান, অন্তত এই মুহূর্তে এই স্বপ্নই তাঁদের হাতিয়ার। অন্য দিকে, এবারকার নির্বাচন পর্বে কেজরীবালের কথায় বার বার যার ইঙ্গিত মিলছিল, তা বাস্তববাদী, ওয়েলফেয়ারিস্ট প্রশাসন। রাজনৈতিক অবস্থানের এই পাঞ্জা-লড়াই গণতন্ত্রেরই লক্ষণ, যদি না নৌকাটাই উল্টে যায়। দল কথা দিয়েছে নতুন ভাবে রাজনীতি করার, কিন্তু দল ক্ষমতায় আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এমন বিদ্রোহে সরব ও সক্রিয় হওয়াটা কি খুব দরকার ছিল? অবশ্য এক অর্থে অবাধ রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের আওতায় রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠার পথে এ ধরনের মতবিরোধ, কলহ-কোন্দল অনিবার্য। প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পরের বছরগুলোতে কংগ্রেস পার্টির কথা ভাবুন, যখন অনেক সোশ্যালিস্ট দল ছেড়ে চলে যান। সে যাত্রায় নেহরু তাঁর ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব দিয়ে দলকে কোনও রকমে বৃহত্তর ভাঙন থেকে রক্ষা করেন।

আপ-এর এই পরিণতি সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজনৈতিকের এক রকম অবশ্যম্ভাবী ডিসিপ্লিনিং। কিন্তু আবার আমাদের দেশের রাজনৈতিক কাঠামোগত সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমেই বড় স্কেলের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। আপ-কে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক দল হবার জন্য আদর্শ ও বাস্তবের মধ্যে আপস-মীমাংসার কৃত্‌কৌশলের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রশান্ত ভূষণের ‘বিশুদ্ধ রাজনীতি’র উচ্চমার্গীয় আদর্শের থেকে ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্রের প্রশাসনিকতার অ্যাজেন্ডা পার্টির আয়ুষ্কালের পক্ষে অনেক বেশি কার্যকর।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE