সলমন খানের মামলার রায় যাহাই হউক, তাহা দিতে আদালতের কেন তেরো বৎসর লাগে? প্রশ্নটি নূতন করিয়া ভারতীয় বিচারব্যবস্থার দুঃসহ দীর্ঘসূত্রিতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। কিন্তু একটি কথা এই প্রসঙ্গে ভুলিলে চলিবে না। এই দীর্ঘসূত্রিতার সম্পূর্ণ দায় বিচারবিভাগের উপর ফেলা যায় না, আইনবিভাগেরও ইহাতে বড় ভূমিকা আছে। সলমন খানের মামলা যখন ২০০২ সালে শুরু হইয়াছিল, তখন মোট ৬৪ জন সাক্ষীর সন্ধান পাওয়া গিয়াছিল। কিন্তু এই তেরো বৎসরে ২৭ জনের বেশি সাক্ষীকে আদালত চত্বরে আনিতে পারা যায় নাই। কেন, তাহা আক্ষরিক ভাবে সর্বজ্ঞাত। সাক্ষীর তালিকা যদি কোনও এক নিভৃত কারণে কেবলই ছোট হইতে ছোট-তর হইয়া যায়, এবং সাক্ষীরা যদি কোনও এক অনির্দেশ্য কারণে কেবলই নিহত, নিরুদ্দেশ কিংবা মৃত হইতে থাকেন, তবে আদালতই বা কী করিবে! বিচারবিভাগও জানে, আইনবিভাগও জানে, সাক্ষীদের এ ভাবে বাতাসে মিলাইয়া যাইবার অর্থ কী। সাক্ষীদের ভয় দেখাইয়া, ব্ল্যাকমেল করিয়া কিংবা হাপিশ করিয়া মামলার পথ বন্ধ করা হয়। যে দেশের যাহা দস্তুর: যে সব মামলায় অভিযোগের আঙুল কোনও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রতি, কিংবা অর্থনৈতিক বৃহৎ-পতির প্রতি, সেখানে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রমাণ-সহকারে কেহ যে আদৌ সাক্ষ্য দিয়া প্রাণে বাঁচিয়া থাকেন, ইহাই আশ্চর্য। এই সর্বজ্ঞাত অনাচারের যে কোনও প্রতিকার হয় না, এ বিষয়ে কোনও আইন পাশ হয় না, তাহার দায়িত্ব কিন্তু দেশের আইন-সভাকেই লইতে হইবে।
সাক্ষী সুরক্ষা আইনের অভাবে অসংখ্য অপরাধের কিনারা হয় না, আরও অসংখ্য অপরাধের কিনারা হইতে যুগ শেষ হইয়া যায়! গুজরাতের বেস্ট বেকারি মামলা (২০০২), দিল্লির নীতীশ কাটরা হত্যা মামলা (২০০২) কিংবা জেসিকা লাল হত্যা মামলা (১৯৯৯), মুম্বই-এর সলমন খানের হিট-অ্যান্ড-রান মামলা (২০০২) তো কতগুলি ‘এলিট’ দৃষ্টান্ত মাত্র। অথচ বিভিন্ন মহল হইতে অনেক দিন হইতেই এ দাবি উঠিতেছে। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিক ডি পি যাদবের ছেলে বিকাশ যাদব নীতীশ কাটরাকে খুন করার পর সাক্ষী-ভাঙাইবার যে ঘৃণ্য কুনাট্য চলে, তাহার পর নীতীশ কাটরার মা নীলম কাটরা ২০০৩ সালে প্রথম সাক্ষী সুরক্ষার দাবিটি আনেন। সেই সূত্রে দিল্লি হাইকোর্ট একটি গাইডলাইন দেয়। এই গাইডলাইনের প্রেক্ষিতেই তৈরি হয় ২০০৬ সালের আইন কমিশনের ১৯৮তম রিপোর্ট। সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়ে তাহাতে ছিল স্পষ্ট কতকগুলি প্রস্তাব। রাজ্যসভার সদস্য-সংবলিত কমিটির প্রস্তাব অতঃপর দ্রুত ঠান্ডাঘরে চালান হয়। জেসিকা লাল মামলার সূত্রে ২০১৩ সালে আবারও দিল্লি হাইকোর্ট দিল্লি সরকারকে সাক্ষী সুরক্ষা লইয়া কিছু করিতে অনুরোধ করে। লাভ হয় নাই।
আজও বিষয়টি একই রকম অচলায়তন। স্বাভাবিক। ভারতীয় সমাজের যে সামন্ততান্ত্রিক আচারবিধির কারণে টাকা ছড়াইয়া কিংবা প্রাণের ভয় দেখাইয়া সাক্ষী ভাঙাইবার কাজটি এত সহজ, ঠিক সেই কারণেই রাজনীতির অঙ্গনেও এ বিষয়ে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া মুশকিল। দলমতনির্বিশেষে রাজনীতিকরা সকলেই স্থিতাবস্থার পতাকাবাহী। নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থের বিপরীতে গিয়া বৃহত্তর জনস্বার্থ পোক্ত করিবার দায় তাঁহাদের থাকিবার কথা নহে। সাম্প্রতিক কালে সাক্ষী-হামলার প্রবণতা আরও বাড়িয়াছে, সম্ভবত গণতন্ত্রের তৃণমূলীকরণের সঙ্গে তাল মিলাইয়া উলঙ্গ ক্ষমতা-লিপ্সা আরও বাড়িবার কারণেই। দৃষ্টির গোচরে প্রতিকারের পথ কেবল একটিই: নাগরিক সমাজ যদি স্থিতাবস্থাকে নাগরিক-সুরক্ষার দায়টি রাষ্ট্র তথা রাজনীতির কর্তব্য হিসাবে মান্য করিতে বাধ্য করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy