Advertisement
১৮ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

প্রকৃতিতে ‘দুর্ঘটনা’ বলে কিছু নেই

ভারতের পরিবেশ-ইতিহাসে জুন মাসটা হয়তো বরাবরের জন্য কালো রঙে চিহ্নিত হয়ে গেল। এক স্মৃতি-ভারাক্রান্ত, পরিত্রাণবিহীন, গভীর শোকার্ত কালো। ঠিক এক বছর আগে ১৫ জুন রাত্রি থেকে ১৬ জুন সকালে হিমালয়ের গঢ়বালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিশৃঙ্খলা যে মাত্রায় পৌঁছেছিল তার নীচে চাপা পড়ে ধ্বংস হয়ে গেল কোটি কোটি বছরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা সূক্ষ্ম জটিল অকল্পনীয় বিরাট প্রাকৃতিক সংস্থান।

জয়া মিত্র
শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৪ ০০:৩৮
Share: Save:

ভারতের পরিবেশ-ইতিহাসে জুন মাসটা হয়তো বরাবরের জন্য কালো রঙে চিহ্নিত হয়ে গেল। এক স্মৃতি-ভারাক্রান্ত, পরিত্রাণবিহীন, গভীর শোকার্ত কালো। ঠিক এক বছর আগে ১৫ জুন রাত্রি থেকে ১৬ জুন সকালে হিমালয়ের গঢ়বালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিশৃঙ্খলা যে মাত্রায় পৌঁছেছিল তার নীচে চাপা পড়ে ধ্বংস হয়ে গেল কোটি কোটি বছরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা সূক্ষ্ম জটিল অকল্পনীয় বিরাট প্রাকৃতিক সংস্থান। অলকানন্দা-মন্দাকিনী-ভাগীরথীর পার্বত্য অববাহিকায় কত মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়েছিলেন সে দিন? আমরা জানি না। দেশি-বিদেশি ইন্টারনেট রিপোর্টে সে সংখ্যা এক লক্ষ পর্যন্ত উঠেছে। নদীর কিনারে, পাহাড়ের খাঁজে, জঙ্গল ঘেঁষে বসা কত গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়? ছ’শো? তারও বেশি? আমরা জানি না। যে মানুষরা সমতল থেকে গিয়েছিলেন, কোনও না কোনও রিজার্ভেশন চার্টে, সমতলের কোনও গৃহে, কোনও বুকিংয়ের খাতাপত্রে যাঁদের হিসেব ছিল, সেই ক’জন মানুষের কথাই কেবল জানা গিয়েছে। এ পৃথিবীর আর কোনও জায়গায় কি প্রাকৃতিক বিধ্বংসে এত মানুষের প্রাণ, বসতি, সংসার মুছে গিয়েছে কখনও?

ভয়নাক বৃষ্টির চাপে ফেটে গিয়েছিল চোরাবারি তাল, যার অন্য নাম গাঁধী সরোবর। নিশ্চয়ই তা-ই। জলের তুফান আছড়ে পড়েছিল কেদারনাথ মন্দিরের গায়ে, গৌরীকুণ্ডে, মন্দাকিনীর খাতে। কিন্তু অলকানন্দায়? কর্ণপ্রয়াগ, শ্রীনগর, দেবপ্রয়াগে? উটের কাঁধে ‘শেষ খড়’টি পড়লে কেমন করে তার ঘাড় মটকে যায়, তা বুঝতে গেলে বাকি বোঝার ওজনটা যাচাই করে দেখতে হবে। একটা চোরাবারি তালকে ওই প্রলয়ের সমগ্র কারণ ভাবা বা সে কথা বলা প্রকৃত সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া। যে বনভূমি, যে পর্বতাংশ লোপ হয়ে গেল তা এ দেশে স্থিত, কিন্তু সমস্ত পৃথিবীরই সম্পদ। এই নীল-সবুজ গ্রহটিই মানুষের একমাত্র বাসস্থান। শুধু মানুষের নয়। মানুষ যার এক অংশমাত্র, সেই সমগ্র প্রাকৃতিক সংস্থান কেবল এই গ্রহটিতেই রয়েছে। এই প্রাকৃতিক শৃঙ্খলাকে যদি মানুষ ছিন্ন করে তবে সে নিজের প্রজাতিকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে আসছে। বহুমুখী, প্রবল এবং শেষ পর্যন্ত অর্থহীন এক বিজ্ঞাপিত আধুনিকতার উন্নয়ন আগ্রাসনে এই প্রাকৃতিক শৃঙ্খলাসমূহ লঙ্ঘন করে আরও আরও বেশি ক্ষমতা আয়ত্ত করতে চান যে মুষ্টিমেয় মানুষ, তাঁরা হিমালয়ের ক্ষত নিরাময় হয়ে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক ছন্দ ফিরে আসার জন্য সসম্ভ্রম অপেক্ষা করার চেয়ে বেশি উচ্চরবে ঘোষণা করতে চান ‘কেদারে যাবার নতুন রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে, মন্দাকিনীর ও-পার দিয়ে।’ অর্থাৎ আবার সেই একই আঘাত, একই আগ্রাসন আবার ঘটছে। এক বছর আগে যে সব আঘাতের ফলস্বরূপ নেমে এসেছিল ওই বিধ্বংস।

কত দূর যায় এই ধসের, এই ধ্বংসের পরিণাম? এই পৃথিবীতে প্রকৃতিতে কোনও কিছুই পরস্পর বিচ্ছিন্ন ভাবে নেই। প্রাকৃতিক সত্য থেকে দূরে সরে থাকা মানুষেরাই কেবল সেই অবিচ্ছিন্নতাকে দেখতে পান না, তাঁদের কাছে সবই খণ্ডিত, তাৎক্ষণিক, সবই অ্যান্টিবায়োটিকে নিরাময়যোগ্য। নিয়ম না বুঝে নিজের যেমন ইচ্ছে সার্থকতা লাভ করতে গিয়ে দেখা যায় না প্রাকৃতিক সংস্থানগুলির ধীর কিন্তু অমোঘ মৃত্যু। ২০১৩ জুনের সেই ভয়াল ধ্বংসকে নিতান্ত নিছক ‘অতিবৃষ্টি জনিত দুর্ঘটনা’, ‘প্রকৃতির খেয়াল’ বলে চিহ্নিত করতে হয়। কিন্তু প্রকৃতিতে তো ‘দুর্ঘটনা’ বা ‘আকস্মিক’ বলে কিছু হয় না। নিয়ম লঙ্ঘিত হতে থাকলে তার যে ফল হওয়ার কথা, তা-ই ঘটে। বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণে আমূল কেঁপে ওঠে পাহাড়। সূক্ষ্ম স্থিতিস্থাপকতাকে অগ্রাহ্য করে তৈরি হয় প্রকাণ্ড সব বাঁধ আর জমা জলের বেসামাল ওজন। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় প্রাচীন জঙ্গল। অন্তর্হিত হয়ে যায় ঝরনাজাল।

গঙ্গোত্রী হিমবাহের বরফ গলে যাচ্ছে ভয়াবহ রকমের দ্রুত। ধবলগিরি (ধৌলাগিরি)-র তুষারশূন্য চূড়ায় কালো পাথর। দেশের আরও বহু এলাকার মতোই নিঃশব্দে বন্ধ, পরিত্যক্ত হয়ে আছে উত্তরবাংলার শিলিগুড়ি-কার্সিয়ং হিলকার্ট রোড, অসংখ্য ধসে। ঝরনা কিংবা পার্বত্য নদীগুলির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু প্রতি দিন বাড়ছে গাড়ির প্রবাহ। পাহাড়ের ঢাল কাঁপছে সাত তলা হোটেলের ভারে। অথচ ওই সব জায়গায় অনেক পুরনো গ্রাম আছে। আছে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা মানুষের সুশৃঙ্খল পরিশ্রমী জীবনযাপন। বহু কাল ধরে প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে জীবন কাটানো সেই মানুষেরা।

হিমালয়ের চেয়ে অনেক দক্ষিণে ভারতের প্রধান জলধারাটি নিজেকে অসংখ্য স্রোতমুখে ভাগ করে সমুদ্রে মিশছে ১৬৮ কিলোমিটার জায়গা ধরে। সেখানে এই দেশের নিজস্ব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলেছিল পৃথিবীর বৃহত্তম নদী-মোহনা বনাঞ্চল-সুন্দরবন। রাজনৈতিক কারণে তার কেবল এক তৃতীয়াংশই এই দেশে। সংখ্যাতীত বিচিত্র উদ্ভিদ ও প্রাণী কে জানে কত কাল ধরে বাস করে নোনাজল-মিঠেজল, বালি ও পলিমাটির এই অসাধারণ প্রাকৃতিক সংস্থানের মধ্যে। এদের মধ্যে কিছু কিছু আছে কেবলমাত্র এখানেই। পৃথিবীর আর কোনওখানে নয়। কিন্তু এখানকার প্রাণরস সেই নদীধারাটি তার সব শাখাপ্রশাখা নিয়ে আজ যখন তীব্র জলাভাবে ভুগছে, যখন সারা দেশের সব জায়গার মতোই ভরাট হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনেরও নদীখাতগুলি, গত ত্রিশ বছরে ধীরে ধীরে বাদাবনের অপেক্ষাকৃত নিচু দক্ষিণাংশের শতকরা বিশ ভাগ নিমজ্জনের ছবি দেখাচ্ছে উপগ্রহের ক্যামেরা, আমরা কি কোথাও পাহাড়ের সঙ্গে সাগরের, বোরো ধানের অথৈ জলতৃষ্ণার সঙ্গে এই বালিমাটিতে ভরে যাওয়া নদীগুলির গভীর সম্পর্ক দেখতে পাই? বুঝতে কি পারি, প্রাকৃতিক সংস্থান বিশৃঙ্খল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আর প্রাণী জীবনের বিপন্নতা? অনুভব করি সেই সব মানুষকে আমার দেশবাসী, আমার স্বভাষাভাষী বলে, যাঁদের বাসভূমি সত্যি সত্যিই ডুবতে বসেছে, কারণ দেশের নগরগুলির চাই আরও বেশি বিদ্যুতের ঝলমলানি?

না কি আধুনিকতার নামে ‘আরও জিনিস, যে কোনও শর্তে আরও বেশি জিনিস’-এর এক অর্থহীন চিৎকৃত প্রচার আমাদের সর্ব চিন্তা, সর্ব বোধশক্তিকে অসাড় করে ফেলেছে ধীরে ধীরে? তিন ঘণ্টার রেল কি বাসযাত্রায় যারা জানালার পাশে বসবার জন্য ব্যস্ত ব্যাকুল হই, জীবন নামক এই এক বার মাত্র টিকিট পাওয়া যাত্রাটির সর্ব দিকে বিস্তারিত এ পৃথিবীর দিকে, সহ-জ উত্তরাধিকারে পাওয়া পরম রহস্যময় প্রকৃতির দিকে কেন বোধকে মেলে দিই না? মোবাইলের গেম খেলার জন্যই কি সেই মানব অস্তিত্ব, যা রাত্রির আকাশে তাকালে তিনশো আলোকবর্ষ দূরের তারাটির আলো তার নিজের চোখে দেখতে পায়?

যদি বিস্মিত হওয়ার, বিহ্বল হওয়ার, বেদনা পাওয়ার বোধ হারিয়ে ফেলতে থাকে মানুষ, নিজের দেশ, সে দেশের নদী মাটি জঙ্গল কিছুই সে আর নিজের বলে বুঝতে না পারে, যদি অন্য মানুষকে দিয়ে বুঝতে না পারে ভালবাসার বোধ, যদি অন্যের পীড়ায় বেদনা না পায়, মানবজীবনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার হাতে থাকে কেবলই এক অলীক লাভের পেনসিল, তবে আর মানুষ কেন? তখন কি মানবস্বভাব-বিরহিত সেই জড়-হয়ে-যেতে-থাকা মানুষদের জন্যই আমাদের শোক, যারা যাচ্ছে বোধবিহীন ধ্বংসের দিকে, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের প্রজাতিকেও?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

probondho jaya mitra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE