সম্প্রতি দেশের প্রাক্তন পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ কলকাতায় এসেছিলেন ১৯৯১ সালের ঐতিহাসিক সংস্কার নিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক বই বিষয়ে বক্তৃতা দিতে। বক্তৃতার আগে আড্ডায়, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক কর্তৃক কয়েক দিন আগে প্রকাশিত ‘ইনটেন্ডেড ন্যাশনালি ডিটারমিন্ড কন্ট্রিবিউশন’, সংক্ষেপে আইএনডিসি বিষয়ে তাঁর মত জিজ্ঞাসা করলাম। মনে রাখতে হবে, এই নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্যারিস মহাসম্মেলনের আগে প্রতিটি দেশকেই তাদের এই বিষয়ক পরিকল্পনার কথা রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি)-র কাছে জমা দিতে হবে, যার ভিত্তিতে প্যারিসে আলোচনা হবে। এবং সেই প্রেক্ষিতে আগামী দিনে বিশ্বের এবং প্রতিটি দেশের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের হার আইনানুগ ভাবে নির্দিষ্ট হওয়ার কথা। সোজা কথায়, এই নথি ও তার সার্থক রূপায়ণ শুধুমাত্র একটি আন্তর্জাতিক দায়িত্বই হতে চলেছে তা-ই নয়, এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে দেশের ভবিষ্যৎ। ভারতের আইএনডিসি’তে গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর জন্য যে পরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে, তা অতিমাত্রায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কথাবার্তার মধ্যে চা এসে পড়ল। বাঙালিদের চা-পানের অভ্যাস নিয়ে জয়রাম রমেশ মন্তব্য করলেন, ‘চিনি বেশি চা কম।’ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভারতের প্রস্তাবেও তা-ই?’ হাসলেন।
বর্তমান পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নথি প্রকাশ করেছেন, তা শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, তাতে প্রচারের চিনিও বেশি। আটত্রিশ পাতার নথির প্রথম আটাশ পাতা জুড়ে মোদী সরকারের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে করা কাজের ফিরিস্তি থাকলেও, ঊনত্রিশ নম্বর পাতাটি বৈপ্লবিক। গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ কমাতে এই পাতায় মোট আটটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তার অন্যতম হল, ভারত ২০৩০ সালে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ঘনত্ব ২০০৫-এর তুলনায় তখনকার জিডিপি’র (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) ৩৩ থেকে ৩৫ শতাংশ কমাবে। এবং তা রূপায়ণ করতে হলে ২০৩০ সালে সারা দেশে মোট যত বিদ্যুৎ তৈরি হবে, তার চল্লিশ শতাংশই নাকি আসবে মূলত সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ বা ছোট মাপের প্রকল্পে পাওয়া জলবিদ্যুৎ থেকে! এ ছা়ড়াও পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিপুল পরিমাণ বনাঞ্চল বাড়ানো হবে, যাতে বাড়তি প্রায় ৩০০ কোটি টন কার্বন ডাইঅক্সাইড বা অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসকে আটকে রাখা যাবে। এ সব লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে ভারতের প্রয়োজন হবে প্রায় ১৬০ লক্ষ কোটি টাকা, যা কিনা ২০১৪ সালে দেশের মোট জিডিপি-র চেয়েও বেশি।
কতটা যুক্তিযুক্ত এই পরিকল্পনা? নথিতেই বলা হচ্ছে, এ সব করতে আন্তর্জাতিক সাহায্য লাগবে, যা পাওয়া যেতে পারে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে, যে ফান্ডের ভবিষ্যৎ খুব একটা স্পষ্ট নয়, যে ফান্ডের কাছে ছোট ছোট দ্বীপরাষ্ট্র থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বলতর অনেক রাষ্ট্র আগেই সাহায্য দাবি করেছে। সেখানে ভারত একই পুঁজির ওপর এত ভরসা করছে কোন ভরসায়? বলা কঠিন, যদি না আমেরিকা বা অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলির সঙ্গে ভারতের ইতিমধ্যেই পর্দার পিছনে কোনও বড় সমীকরণ তৈরি হয়ে থাকে। যদি তা হয়ও, সেটা যে যথেষ্ট আপসের বিনিময়ে আসবে, তা বোঝা সহজ।
অবশ্য শুধুমাত্র টাকার অঙ্কেই নয়, নব্য নথির যুক্তি সামগ্রিক ভাবেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। বিদ্যুতের ব্যাপারটাই দেখা যাক। এই মুহূর্তে দেশে মোট বিদ্যুৎ তৈরি হয় প্রায় ২ লক্ষ ৮০ হাজার মেগাওয়াটের মতো, যার মধ্যে অ-চিরাচরিত পদ্ধতিতে তৈরি হয় ৩৬০০০ মেগাওয়াট, অর্থাৎ ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে সৌরশক্তি আছে ৪০০০ মেগাওয়াটের সামান্য বেশি, ছোট মাপের জলবিদ্যুৎও কাছাকাছি, আর বাতাস থেকে বিদ্যুৎ তৈরি হয় ২৪০০০ মেগাওয়াটের আশেপাশে।
দেশের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রকাশিত নথি অনুযায়ী এই ৩৬০০০ মেগাওয়াটকে আগামী দেড় দশকের মধ্যে ১,৭৫,০০০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধা প্রধানত তিনটি। আর্থিক প্রয়োজনের পাশাপাশি বাধা জমি, যা নিয়ে সমস্যার শেষ নেই। গড়ে ১ মেগাওয়াট সৌরশক্তি তৈরিতে প্রয়োজন ৪ একর জমি। অর্থাৎ লক্ষ্য পূরণ করতে লাগবে কলকাতার মাপের অন্তত আটটি শহর!
পাশাপাশি রয়েছে প্রযুক্তিগত সমস্যাও। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি দেশের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ সত্যি সত্যিই অ-চিরাচরিত পদ্ধতিতে তৈরি হয়, তবে বর্তমান গ্রিডের ভারসাম্য রাখা প্রায় অসম্ভব। ‘মনে রাখতে হবে, অ-চিরাচরিত বিদ্যুৎ অনিয়মিত, সব সময় পাওয়া যায় না। যেমন রাতের বেলা সৌরবিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না। সুতরাং, এই বিপুল পরিমাণ অ-চিরাচরিত বিদ্যুৎ গ্রিডে নিলে বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলিকে দিন-রাতের ফারাক সামলাতে যে-ব্যবস্থা রাখা হবে, তা ব্যবসায়িক দিক থেকে মোটেই সুবিধাজনক হবে না,’ মন্তব্য করলেন সৌরবিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞ শান্তিপদ গণচৌধুরী।
পরিবেশ অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ নীলাঞ্জন ঘোষ ও তাঁর সহকর্মীরা তাঁদের সদ্য প্রকাশিত বই নেচার, ইকনমি অ্যান্ড সোসাইটি-তে একটি বৃহত্তর প্রশ্ন তুলেছেন, ‘দেশের জমি মূলত তিন ভাগে বিভক্ত: শহর, শহরতলি ও গ্রামে থাকার জায়গা, চাষের জমি ও বনাঞ্চল। যদি সৌরবিদ্যুৎ তৈরিতে বিপুল জমি লাগে, তা হলে জঙ্গল কেটেই সেই জমি নিতে হবে। কিন্তু আইএনডিসি-র পরিকল্পনায় তো বনাঞ্চলকে বিপুল ভাবে বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। অঙ্কের হিসেবে অর্ধেক পশ্চিমবঙ্গ!’ একই সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ এবং জঙ্গল, দুইই বাড়ানো কী করে সম্ভব? ‘এ থেকেই প্রমাণ হয় যে আমরা এখন পরিবেশের ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ পরিকল্পনা করতে শিখিনি’, মত বিশেষজ্ঞদের।
যদি এটা মনে রাখা যায় যে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার বহু ক্ষেত্রেই তথাকথিত উন্নয়নের নাম করে বনাঞ্চল সাফ করে শিল্পস্থাপনের অনুমতি দিচ্ছে, বা কয়লা-ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ ব্যবস্থার গুরুত্ব বাড়ছে বই কমছে না, তবে ভারতের দেওয়া লক্ষ্যমাত্রাগুলিকে খানিকটা অসারই মনে হয়। এই হিসেব মেলানো যায় না, যখন দেখা যায় যে, সরকার সৌর বিদ্যুতের রুফটপ অর্থাৎ ছাদে লাগানোর প্যানেল প্রচলনের লক্ষ্যমাত্রা বিপুল পরিমাণে বাড়ানোর পাশাপাশি এ বিষয়ে আগের সরকারের ভর্তুকি কার্যত তুলে দিয়েছে!
ভয়টা এখানেই। ভারত যেন যথাসম্ভব গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ কমায় ও অনেক বেশি পরিমাণে অ-চিরাচরিত বিদ্যুৎ তৈরি করে, সেটাই কাম্য। কিন্তু সেই বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা যদি না থাকে, এবং যদি প্রয়োজনীয় আর্থিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত সম্পদের ব্যবস্থা না হয়, তবে হিতে বিপরীত হওয়াটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে জুয়া খেলা যায়, কিন্তু ১২০ কোটির দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy