বাঘের পিঠে সওয়ার হইয়া রাজনীতি-যুদ্ধে জিতিতে বড় সুখ। কিন্তু তাহার পর বাঘই যখন পিঠের উপর চড়িয়া পড়ে, সুখবোধ তখন বাপ বাপ বলিয়া পালায়। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু সমাজের বাঘ এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিঠে চড়িতে ব্যস্ত। এত দিন সংখ্যালঘু ভোটের মুখপানে চাহিয়া মুখ্যমন্ত্রী রকমারি ‘মুসলিম’ তোষণের চেষ্টা করিয়াছেন, প্রতিশ্রুতির ঝড় বহাইয়াছেন। ইমামদের জন্য মাসে আড়াই হাজার টাকা বৃত্তি, মুসলিমদের জন্য পৃথক ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা, ৫০০ কোটি টাকার মসজিদ উন্নয়ন ফান্ড, মাদ্রাসার উন্নয়ন ও বৃদ্ধি, ২০১১ সাল ইস্তক একের পর এক বর দিয়া গিয়াছে নবজাত তৃণমূল সরকার। এমনও দাবি করিয়াছেন যে, তাঁহার সরকার প্রতিশ্রুতি পালনে ১০০ শতাংশ সফল। প্রতিশ্রুতি ও দাবির এই ঝড়ের সামনে সংখ্যালঘুর প্রত্যাশা লাফাইয়া বাড়িয়াছে, জন্ম লইয়াছে ক্ষোভের সাইক্লোন। সম্প্রতি রাজ্যের মুসলিম নেতারা প্রকাশ্য সভা করিয়া জানাইয়া দিয়াছেন, মুখে সহস্র সহানুভূতি সত্ত্বেও মমতার শাসনে তাঁহাদের জন্য কাজের কাজ কিছু হয় নাই। হুমকি দিয়াছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের উপর হইতে সমর্থন তাঁহারা তুলিয়া লইবেন, আমরণ অনশনে বসিবেন। মূল অভিযোগটি মাদ্রাসা সংক্রান্ত। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসিবার পর গত চারটি বৎসরে অনুমোদনপ্রাপ্ত নূতন মাদ্রাসার সংখ্যা মাত্র এক, অভিযোগ ইহাই। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের মতে: রাজ্য কোষাগারের দুরবস্থার কারণেই এই পরিস্থিতি। পরিস্থিতির আগাম বিচার ছাড়াই প্রতিশ্রুতি কেন? পুরমন্ত্রী উত্তর জানিলেও বলিতে পারিবেন না।
নির্বাচনী গণতন্ত্রে প্রতিশ্রুতি যে সাময়িক যুদ্ধাস্ত্র, নেতাদের পক্ষে জনগণের সামনে তাহা কবুল করা কঠিন। সংখ্যালঘুর ক্ষেত্রে কঠিনতর। কী ভাবে বলা সম্ভব যে কেবল ভোটতরণী পার করিবার জন্যই রাজনীতিতে এবং রাজনৈতিক সমাজে সংখ্যালঘুর প্রয়োজন? কাজ ফুরাইলেই তাহাদের কথা ভুলিয়া যাওয়ার চল তো শুধু তৃণমূল কংগ্রেসে নয়, বর্ষে বর্ষে দলে দলে সকল রাজনীতিরই মজ্জাগত। এবং সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিষয়টি তুলিয়া ধরিয়া বিরোধী দলের সংখ্যালঘু তাস খেলিবার অভ্যাসটিও সকল রাজনীতির সাধারণ কু-অভ্যাস। উহারা কিছু করে নাই, আমরা ক্ষমতা পাইলেই করিব— এই মহাশ্বাসবাণী বাম জমানার শেষ দিকে মমতার তৃণমূল কংগ্রেসও দিয়াছে, আর আজ তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতার অবকাশে কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়াও দিতেছেন। প্রায় সকল বিষয়ে দ্বিমত থাকিলেও রাজ্য কংগ্রেসের মুসলিম কার্ডটি বড় করিয়া খেলিবার ব্যাপারে সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব পাশে দাঁড়াইতে আগ্রহী। স্বাভাবিক। ভারতের (এবং পশ্চিমবঙ্গের) গণতন্ত্রে সংখ্যালঘু রাজনীতির মার নাই। সংখ্যাতত্ত্বই বলিয়া দেয়, মুসলিমরা ভোটলক্ষ্মী!
প্রতিশ্রুতি একটি সমস্যা ঠিকই। তবে তাহাই একমাত্র সমস্যা নয়। প্রতিশ্রুতির রূপও যে কত বড় সমস্যা তৈরি করে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাহা দেখাইয়া দিয়াছেন। মুসলিম ভোট টানিবার জন্য তিনি মুসলিম সমাজের সর্বাঙ্গীণ সংস্কারের উপর ভর করেন নাই, প্রাথমিক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, দারিদ্র দূরীকরণের মতো মৌলিক ক্ষেত্রে নজর দেন নাই। বরং মুসলিম ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে মাথায় তুলিয়াছেন। ভোট-কারবারি রাজনীতিকদের মধ্যেও তাঁহার ধরনটি সংকীর্ণতম, স্বার্থপরতম: মুসলিম পশ্চাদপরতা কমাইবার কথা বলিতেও যতটা পরিশ্রম, তাহার পাশ কাটাইয়া ইমামদের তোয়াজ করিয়া ধর্মের নামে ভোট কুড়ানোই তাঁহার কাছে সহজ ঠেকিয়াছিল। রাজনীতির দাপটে এত দিন পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা বিপন্ন ছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রক্ষণশীল রাজনীতির ঢেউয়ে তাঁহাদের সর্বনাশের ব্যবস্থা হইয়াছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy