মু ম্বইয়ে উত্পন্ন জনপ্রিয় সিনেমায় মৃত্যুদণ্ডের মামলা লইয়া যে ধরনের চড়া পর্দার নাটক দেখা যায়, ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি উপলক্ষে নাটকীয়তা তাহা অপেক্ষা কোনও অংশে কম ছিল না। সারারাত্রিব্যাপী বিচারের নমুনা চলচ্চিত্রেও দুর্লভ। রাষ্ট্রপতির নিকট প্রাণভিক্ষার নূতন আবেদন হইতে শুরু করিয়া দণ্ডাজ্ঞা কার্যকর করিবার উপর পক্ষকালের স্থগিতাদেশ জারির জন্য সুপ্রিম কোর্টে চূড়ান্ত আবেদন অবধি সমস্ত পর্বটিতে তীব্র উত্তেজনা বহাল ছিল। এক অর্থে ইহা ভারতীয় বিচারপ্রক্রিয়ার নীতিনিষ্ঠতার প্রমাণ। আইন মোতাবেক যাহা কিছু করিবার আছে তাহা করিতে হইবে, চরম ও চূড়ান্ত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিও, মার্জনার পূর্ববর্তী সমস্ত আবেদন খারিজ হইবার পরেও, কার্যত অন্তিম মুহূর্তে দণ্ডাদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন জানাইলে সেই আবেদন বিচার করিতে হইবে এবং সে জন্য প্রয়োজনে মধ্যরাত্রে আদালত বসাইতে হইবে— এই ঐকান্তিকতার মূল্য অনস্বীকার্য। মৃত্যুদণ্ড আজও, এই ২০১৫ সালেও, অনেক দেশেই চালু আছে। বিশেষত প্রতিবেশী চিনে তাহার বহুলব্যবহার অবিরত চলিতেছে। সেই প্রেক্ষিতে দেখিলে মানিতেই হইবে যে, ইয়াকুব মেমন কাহিনির নাটকীয়তার একটি ইতিবাচক তাত্পর্য আছে।
কিন্তু সম্পূর্ণ এবং ত্রুটিহীন বিচারের জন্য এই রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তার প্রয়োজন ছিল কি? বিশেষত, যে মামলা একুশ বছর ধরিয়া চলিয়াছে, তাহার অন্তিম পর্ব এমন টর্নেডো-প্রতিম কেন? উত্তর নিহিত থাকে প্রশ্নের গভীরে। এ দেশে বিলম্বিত বিচারের সমস্যাটি বহুচর্চিত। এ বিষয়ে মহামান্য আদালতের বিচারপতিরাই বারংবার উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছেন। ইয়াকুব মেমনের বিচারও সেই ধারাতেই অতি দীর্ঘায়িত। অতিকায় ফৌজদারি অপরাধের বিচারে কিছুটা বেশি সময় লাগিবে, তাহা মানিয়া লওয়া যায়, কিন্তু একুশ বছর? সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখিয়া আদালত যে সিদ্ধান্ত স্থির করিয়াছে এবং সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সব কয়টি স্তর অতিক্রম করিয়া যে আদেশ বহাল থাকিয়াছে, তাহা কার্যকর করিতে এত বিলম্ব কেন, এত অনিশ্চয়তাই বা কেন? ‘পদ্ধতিগত’ ত্রুটির অভিযোগ কেন দীর্ঘতর বিলম্বের কারণ হইয়া উঠিবে? মার্জনা ভিক্ষার আবেদন সম্পর্কেই বা প্রশাসন কেন অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত স্থির করিবে না? এই ধরনের গুরুতর মামলার প্রত্যেকটি পর্বে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার নিষ্পন্ন করিবার জন্য কি তবে আইনি বাধ্যবাধকতা আবশ্যক? ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট আবশ্যক?
না। যাহা আবশ্যক তাহার নাম দ্রুত এবং দক্ষ বিচারপ্রক্রিয়া। মহামান্য বিচারপতিরা তত্পর হইলে তাহা সম্ভব হইতে পারে। প্রথমত, কোন মামলা তাঁহারা গ্রহণ করিবেন, কোনটি পত্রপাঠ খারিজ করিবেন, তাহার উপর আদালতের কাজের ভার অনেকখানি নির্ভর করে। দ্বিতীয়ত, আইনজীবীদের দীর্ঘসূত্রিতা বা অন্যবিধ অসহযোগিতার কারণে যাহাতে মামলা বিলম্বিত না হয়, সে জন্য লিখিত নথির ভিত্তিতে, আইনজীবীদের সওয়াল ছাড়াই, মামলার নিষ্পত্তি কত দূর সম্ভব তাহা তাঁহারা বিবেচনা করিতে পারেন। সর্বোপরি, মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষকে, বিশেষত প্রশাসনকে বাধ্য করিবার অধিকার আদালতের আছে। অধুনা কোনও কোনও আদালতে বিচারপতিরা বিচারের গতি দ্রুততর করিবার উদ্দেশ্যে কিছু কিছু পদক্ষেপ করিতেছেন, ইহা আশাব্যঞ্জক। কলিকাতা হাইকোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক তত্পরতা তাহার একটি দৃষ্টান্ত, যদিও তিনি হয়তো আরও অনেক বেশি কঠোর হইতে পারিতেন। প্রয়োজন বিচারব্যবস্থার সামগ্রিক সংস্কারের। মৃত্যুদণ্ডের মামলাগুলি সেই সামগ্রিক ব্যবস্থার একটি অঙ্গ। এক একটি অঙ্গের স্বতন্ত্র চিকিত্সা সুচিকিত্সা নহে, যথাযথ ঔষধ পড়িলে সমস্ত অঙ্গেরই উপকার হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy