তেরো পার্বণে আর একটি নতুন পার্বণ এ বছর যুক্ত হল, বই-পার্বণ। বইমেলা নামে বই নিয়ে একটি বিস্তর বাড়াবাড়ি প্রতি বছর সরকারি আনুকূল্যে ঘটে থাকে। সেটা মোটামুটি বাঙালির গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সদ্য গোলদিঘিতে আতসবাজি সহকারে যে উৎসবটির সমাপন হল সেটিকে, এক কথায় বলা যায় এক ধরনের সুভাষণ। ঘরে চাল না থাকলে গৃহিণীরা বলে থাকেন চাল বাড়ন্ত। আজ, বিশ্ব বই দিবস উপলক্ষে এত কাল বইয়ের যে ‘গুদাম সাবাড় সেল’ আয়োজন করতেন পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড, সেই বইবাজারকে তাঁরা এ বার বললেন, বই উৎসব।
বাজার শব্দটা বাঙালি বইটইয়ের ক্ষেত্রে কোনও দিনই খুব ভাল মনে নেয় না। তেল-সাবান, চিনি-নুন, শাড়ি-জামার মতো বইও যে একটা পণ্য, এটা ভাবতেই আমাদের কষ্ট হয়। হাতিবাগানের চৈত্র সেলের সঙ্গে কলেজ স্কোয়ারে গ্রন্থ সেলের যে বিশেষ ফারাক নেই, সে কথাটা বলতে গেলে তো বিদ্বজ্জন বাঙালি তেড়েই আসবেন রে রে করে।
যদি বছরভর নানা ছকে বইও আর পাঁচটা জিনিসের মতো করে বিক্রিই করতে হয় তবে এত বই উৎপাদনের দরকারটা কী? এই প্রশ্নটা কেউ করেন না। মূলত প্রকাশক ও বইবিক্রেতাদের উদ্যোগে বইকে একটি পবিত্র পণ্য হিসেবে প্রোমোট করা হয়েছে এত কাল ধরে। যেন বইয়ের ব্যবসাটা আসলে ব্যবসা নয়, সেবা। সাহিত্যসেবা।
এই ধারণাটায় ধুনোর মতো কাজে লাগানো হয়েছে বই সম্পর্কে নানা চিন্তাবিদের নানা কথাকে। বইমেলার মাইকে নানা রকম বাণী মাঝে মাঝেই প্রচারিত হয়, বই কিনে কেউ কখনও দেউলে হয় না, বই সেরা উপহার, জীবনের পরম বন্ধু বই।
কথাগুলো শুনতে দারুণ, কিন্তু মানুষের প্রকাশের সেরা মাধ্যম বই, এমন কথা ভাবার আসলে কোনও কারণ নেই। বই-স্তুতিতে বাঙালি রবীন্দ্রনাথের কথা ধার করে প্রায়ই। এমনিতে সব কিছুতে রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনাটা মুদ্রাদোষ হলেও এ ক্ষেত্রে কথাটা কাটতে হলে রবীন্দ্রনাথকেই চাই। বই পড়াটাই যে শেখা, ছেলেদের মনে এই অন্ধ সংস্কার যেন জন্মাতে না দেওয়া হয়, তা নিয়েও কিন্তু সতর্ক করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন, ‘বইয়ের ভিতর দিয়া জানাকেই আমরা পাণ্ডিত্য বলিয়া গর্ব করি। জগৎকে আমরা মন দিয়া ছুঁই না, বই দিয়া ছুঁই।’ আরও অনেক বিষয়ের মতো বাঙালিকে গ্রন্থকীট করে তোলাতেও বড় অবদান আছে রবীন্দ্রনাথেরই। কিন্তু বই নিয়ে বাড়াবাড়িটা তাঁরও পছন্দ ছিল না। শিক্ষাকে তিনি বইয়ের ভার থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন বার বার। প্রকৃতির সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে মানুষের সহজ যোগাযোগের মাঝে যে কখনও কখনও বাধা হয়ে ওঠে বই, বলেছেন সেটাও। তাঁর একটি প্রবন্ধ ‘লাইব্রেরি’-কে আমরা অনেক সময়ই বইয়ের গুণ গাইতে ব্যবহার করি। কিন্তু নিতান্ত তরুণ বয়সে (১৮৮৫) লেখা সেই প্রবন্ধে কিঞ্চিৎ ব্যাজস্তুতিও আছে। ‘এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে!’ কিংবা একটু পরে, ‘বিদ্যুৎকে মানুষ লোহার তার দিয়া বাঁধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে। কে জানিত সংগীতকে, হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মার আনন্দধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে!’
চব্বিশ বছরের তরুণ রবীন্দ্রনাথ, বাংলা বইয়ের সেই অল্প নিয়ে থাকা আদিপর্বে বাঙালিকে বই লিখতে উৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন। ‘দেশ-বিদেশ হইতে, অতীত-বর্তমান হইতে প্রতিদিন আমাদের কাছে মানবজাতির পত্র আসিতেছে, আমরা কি তাহার উত্তরে দুটি-চারটি চটি চটি ইংরেজি খবরের কাগজ লিখিব!’ বাঙালি ঠাকুরের বাণী বুঝেছে নিজেদের মতো করে। দেখিয়ে দিয়েছে কত বই সে লিখতে পারে! এক রবীন্দ্রনাথের লেখাই যে কত বিচিত্র সম্পাদনায়, বিচিত্র ছকে ছাপানোর পথ বের করা যায়, বাঙালি দেখিয়েছে। অন্য বইয়ের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। মসীজীবনে বাঙালির এমন মতি দেখে রবীন্দ্রনাথ হয়তো বলতেন, দাও ফিরে সে কপিরাইট!
বিশ্ব বই দিবসের সঙ্গে আজ, ২৩ এপ্রিল কপিরাইট দিবসও। মনে হয়, এ কালে বইয়ের বাড়াবাড়ি বন্ধ করার সেরা উপায় কপিরাইট আইনটাই বদলে ফেলা। লেখকের মৃত্যুর পরে ষাট বছর নয়, কাগজে ছাপা বইয়ের কপিরাইট থাক চিরকাল। অন্য কোনও মাধ্যমে বরং সে বইয়ের প্রকাশের দরজাটা খুলে দেওয়া হোক। কাগজ বাঁচবে অনেক, গাছও।
অবশ্য তাতে অনেকের ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘বইপড়ার আবশ্যক নানা কারণে হইয়া থাকে। সর্বপ্রথম, ঘুম আনিবার জন্য। দ্বিতীয়ত, যে ধরনের জীবন যাপন করিবার ইচ্ছা আছে অথচ করিবার মতো সামর্থ্য নাই, সেই জীবনের বিবরণ পড়িয়া উহাকে নিজের জীবন বলিয়া কল্পনা করিবার জন্য। তৃতীয়ত, জৈব উত্তেজনা আনিবার জন্য অর্থাৎ মুদ্রিত রূপে মানসিক মদনানন্দমোদক খাইবার জন্য। চতুর্থত, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাকে প্রসারিত করিবার জন্য, এবং জ্ঞান ও অনুভূতি বাড়াইবার জন্য।’
প্রথম তিনটি প্রয়োজন মেটানোর বহু উন্নততর উপায় ইতিমধ্যে হাতের মুঠোয় এসেছে। কেবল শেষেরটির জন্যই বই থাকলেও থাকতে পারে। সেই বই, যা নতুন কথা বলে, নতুন করে ভাবায়। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই বই লেখাটা এখন প্রায় মুদ্রাদোষে পরিণত। সেই স্বভাব যদি বদলায় তবে কলকাতা বইমেলাটাই কিন্তু দিব্য হাত পা ছড়িয়ে এঁটে যেতে পারে গোলদিঘিতে!
বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার, প্রোডাকশন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy