১৯৩৭-এর নভেম্বরে কলিকাতা হইতে প্রকাশিত মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় ‘রাষ্ট্রপতি’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছিল। তাহার মূল প্রতিপাদ্য ছিল, জওহরলাল নেহরু যদি একনাগাড়ে তৃতীয় দফায় কংগ্রেসের সভাপতি (তখন যে পদটির নাম ছিল রাষ্ট্রপতি) নির্বাচিত হন, তবে তাহা দলের পক্ষেও ভাল হইবে না, তাঁহার নিজের পক্ষেও নহে। কারণ, তাহা হইলে তিনি নিজেকে অপরিহার্য জ্ঞান করিবেন— তাহা হইতে দেওয়া যায় না। ভারতীয় রাজনীতির পাঠকমাত্রেই জানিবেন, চাণক্য ছদ্মনামের আড়ালে প্রবন্ধটির লেখক ছিলেন স্বয়ং জওহরলাল। খানিক ছেলেমানুষি, কিঞ্চিৎ আত্মমুগ্ধতার পাশাপাশি প্রবন্ধটিতে জওহরলালের একটি গভীর বিশ্বাসও লুকাইয়া ছিল। তিনি বিশ্বাস করিতেন, প্রতিষ্ঠান অপেক্ষা, রাষ্ট্র অপেক্ষা কোনও ব্যক্তি কখনও বড় হইতে পারেন না। সেই ব্যক্তি জওহরলাল নেহরু নামক এক মহীরুহ হইলেও নহেন। ১৯৩৭-এর পরবর্তী ভারত সাক্ষী, নেহরুর ছায়া দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হইয়াছে। কিন্তু সেই ছায়ায় যেন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলি ঢাকা না পড়িয়া যায়, নেহরু সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তিনি আধুনিক ভারতের মন্দির গড়িয়াছিলেন, কিন্তু সেই মন্দিরে নিজের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করিতে চাহেন নাই।
নেহরু অতীত হইয়াছেন, কিন্তু উত্তরসূরিদের নিকট তাঁহার প্রয়োজন ফুরায় নাই। নিজেদের ক্রমবর্ধমান ক্ষুদ্রতাকে ঢাকিতে নেহরুর বিগ্রহ, এবং তাহার অতি দীর্ঘ ছায়া তাঁহাদের নিকট অপরিহার্য হইয়াছে। সেই বিগ্রহ যেন তাঁহাদের উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি। অতএব, মন্দির প্রয়োজন হইয়াছে। নেহরুর বাসস্থান তিনমূর্তি ভবনেই গড়িয়া উঠিয়াছে জওহরলাল নেহরু সংগ্রহশালা। এমন ভাবে, যাহাতে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান অপেক্ষা, অন্যান্য রাষ্ট্রনায়ক অপেক্ষা নেহরুর আসন উচ্চতর হয়। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ভাবিতেছে, নেহরু সংগ্রহশালাটিতে আর জওহরলাল নেহরুই একমাত্র থাকিবেন না। তাহাতে আধুনিক ভারতের আরও অনেক কিছু ঠাঁই করিয়া লইবে। স্মার্ট সিটি হইতে মঙ্গলযান, অনেক কিছুই থাকিবে। প্রশ্ন উঠিতেই পারে, ঘটমান বর্তমানের কি জাদুঘর হয়, নাকি হওয়া উচিত? প্রশ্নটি অন্যায্য নহে। তিনমূর্তি ভবনের সংগ্রহশালায় কী থাকিতে পারে, তাহা খোলা প্রশ্ন। কিন্তু, কী থাকিতে পারে না, তাহাতে কোনও সংশয় নাই। রাষ্ট্রীয় প্রযত্নে কোনও ব্যক্তিবিশেষের সংগ্রহশালা চলিতে পারে না। তিনি জওহরলাল নেহরু হইলেও নহে।
তাহাতে নেহরুর গুরুত্ব কোনও মতেই খাটো হয় না। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে তাঁহার অবদান অস্বীকার করিবার কোনও প্রশ্ন নাই। কিন্তু, তিনি বা অন্য কোনও ব্যক্তিবিশেষ নহেন, কেন্দ্রস্থলে থাকিবে ভারত নামক দেশটি। সেই দেশের গতিপথে নেহরুরা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, কিন্তু পথ ও মাইলফলকের মধ্যে গুলাইয়া ফেলিলে ভুল হইবে। আজ ভারত যেখানে দাঁড়াইয়া আছে, তাহাতে অনেকেরই অবদান। এক জনের উপর বিশেষ মাহাত্ম্য আরোপ করিলে অন্যদের লঘু করিয়া ফেলা হয়। তাহা অমার্জনীয়। নরেন্দ্র মোদী উদ্যোগী হউন। ভারতের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটির রূপকারদের প্রাপ্য গুরুত্ব দিন। তবে, এক নেহরুকে সরাইয়া এক পটেল অথবা এক গোলওয়ালকর বা সাভরকরকে সেই দেবতার আসনে বসাইলে তাহা আরও বড় ভুল হইবে। গত দেড় বৎসরে তাঁহার সরকার যে পথে চলিয়াছে, তাহাতে অনেকেরই সন্দেহ হইতে পারে, নেহরু সংগ্রহশালা হইতে নেহরুর গুরুত্বহ্রাস হয়তো কোনও নীতিগত সিদ্ধান্ত নহে, নেহাতই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের প্রকাশ, অথবা রাজনৈতিক মতবাদের দ্বন্দ্ব। সন্দেহটি যে অমূলক, তাহা প্রমাণ করিবার দায়িত্ব নরেন্দ্র মোদীর উপরই বর্তায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy