Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সাক্ষাত্কার

ভারতের কাছে বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনেক

আওয়ামি লিগ বরাবরই দিল্লিকে বোঝাতে চেয়েছে, তারা কোনও ভাবেই ভারত-বিরোধিতাকে সমর্থন করে না। বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। কলকাতায় তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরীশাহবাগ আন্দোলন ভাঙবার পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। নিজেদের মধ্যে বিরোধ যেমন তৈরি হচ্ছিল, তেমনই আন্দোলন বিভাজন সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারও কিন্তু নির্দিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল।

মৈত্রী। বিএসএফ কর্মী রাখি পরিয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীর হাতে। অগস্ট, ২০১৪।

মৈত্রী। বিএসএফ কর্মী রাখি পরিয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীর হাতে। অগস্ট, ২০১৪।

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

গত বছর বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সেখানে, এবং ভারতেও, যথেষ্ট উদ্দীপনা ও প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল। এই বছরের গোড়ায় নির্বাচনের সময় পর্যন্ত এই উত্‌সাহ এ দেশে যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। অথচ, আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার পরে এবং নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশের সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে এখানে তেমন আর খবরাখবরই মেলে না। তাই জানতে চাইব যে, শাহবাগ আন্দোলনের পরিণতি কী দাঁড়াল? এর ফলে সমকালীন বাংলাদেশের পরিস্থিতির কি কোনও রদবদল লক্ষ করেছেন আপনি?

শাহবাগ আন্দোলন ভাঙবার পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। নিজেদের মধ্যে বিরোধ যেমন তৈরি হচ্ছিল, তেমনই আন্দোলন বিভাজন সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারও কিন্তু নির্দিষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল। সে যা-ই হোক, মোদ্দা কথা হল, এই স্বপ্ন দেখানো আন্দোলন শেষ অবধি ভেঙে গেল। বস্তুত, মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই ধরনের ঐক্য আর কখনও নজরে আসেনি। কাজেই, শেষ পর্যন্ত শাহবাগ আন্দোলনের এই পরিণতি বাংলাদেশের পক্ষে অত্যন্ত দুঃখজনক এবং হতাশাব্যঞ্জক।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে ধরনের ভয়ানক যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, ইদানীংকালে তার বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাকে কেন্দ্র করে বিতর্কও হয়েছে প্রচুর। অনেকে বলেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার বিচারে টোকিয়ো ট্রাইবুনাল বা সম্প্রতি যুগোস্লাভিয়াতে যুদ্ধাপরাধ বিচারের উদ্দেশ্যে যে ভাবে অন্য দেশ থেকেও বিচারপতিদের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশে তা না হওয়াটাই এই বিতর্ক বা সমাজের মেরুকরণের অন্যতম প্রধান কারণ। কী বলবেন?

আসলে এই যুদ্ধাপরাধের বিচার অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। শেষ অবধি কাজটা শুরু হল বটে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলির বিচার চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এই ধরনের মামলার আপিলের নিষ্পত্তি হচ্ছে আরও ধীরে। এই ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে জামাত-এ-ইসলামি’র মতো রাজনৈতিক দলের কোনও আঁতাত হয়েছে, এমন কথা বলব না। অথচ, এটা রূঢ় বাস্তব যে, সরকারের তরফে এই মামলাগুলিতে গতি আনবার জন্য তেমন কোনও প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি সত্যই অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি, তা আমার জানা নেই।

আপনার কি মনে হয় যে, জানুয়ারির নির্বাচনের পরে সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে? বাইরে থেকে মনে হয়, অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভাল। সত্যিই কি তাই?

এটা ঠিকই যে, এই সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কিছুটা হলেও বেড়েছে। বিগত মাস ছয়েক ধরে সরকার নিজের অবস্থা অনেক শক্তিশালী করেছে। কিন্তু পাশাপাশি দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে। শাসক দলের অনেক সাংসদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এতে সরকার এবং শাসক দলের দুর্নামও বেড়েছে।

বাংলাদেশের এই সরকারকে পশ্চিমী দেশগুলি ক্রমশ মেনে নিয়েছে। কিন্তু জানুয়ারির ভোটের পরে তো এর বৈধতা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছিল।

এটা ঠিকই যে, পশ্চিমী দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলি নির্বাচনের পরেও বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এতে বাংলাদেশের সরকার শক্তিশালীই হয়েছে। মনে রাখা দরকার, আমেরিকা ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নই সেই সময়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বৈধতা নিয়ে বিশেষ ভাবে প্রশ্ন তুলেছিল। আবার এই ইইউ-এর তরফেই কিন্তু বাংলাদেশকে বর্ধিত আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা করা হয়েছে। সেটা বাংলাদেশের এখনকার স্থিতিশীলতা দেখে কি না, তা অজানা। সামগ্রিক বিচারে এই সরকারের আইনগত ভিত্তি নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। তবে নৈতিকতার প্রশ্ন থেকেই গেছে।

সরকারের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, অথচ আইনগত বৈধতা নিয়ে তেমন প্রশ্ন নেই, এই বৈপরীত্যকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশে এখনও বিতর্ক আছে। ২০০৭ সালে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে দেশের প্রধান দুই দলের যে ধরনের মনোভাব ছিল, ইদানীং কালে তা দেখা যায়নি। বিতর্ক এতে বেড়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও সংকটের মধ্যে পড়েছে। দেশও। উপরন্তু, সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন নিজস্ব শক্তি ও সামর্থ্য দেখাতে পারেনি।

কিন্তু এর পাশাপাশি বিরোধীদের আন্দোলনও স্তিমিত। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) কার্যত নিষ্ক্রিয়। ভোটের ঠিক আগে, গত বছরে নভেম্বর-ডিসেম্বরে, তুমি যখন ঢাকায় ছিলে, তখন বিরোধী দলগুলির আন্দোলনের প্রভাব জনজীবনে পড়েছিল। বিরোধীদের আন্দোলনে জনগণের যোগ না থাকলেও দৈনন্দিন বিপর্যয় হতে পারে। যেমনটা তখন দেখেছিলে। এখন তা নেই।

আগে যখন জামাত আন্দোলনের পথে পা বাড়িয়েছিল, বিএনপি তখন জামাতের পাশে দাঁড়ায়নি। এখন বিএনপি নতুন করে আন্দোলনের কথা ভাবলেও তাতে জামাতের সাড়া মিলছে না। অন্য দিকে, বিএনপি-র সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছেই। দলের নেতাদেরও জনসাধারণের কাছে তেমন স্বীকৃতি নেই। তাই সরকারের বর্তমান মেয়াদ পূরণের পথে আপাতত কোনও বাধা নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বাইরের জগতের উত্‌সাহও তো এখন কম। গণজাগরণ মঞ্চ উদ্দীপনামূলক ছিল, এখন শুধুই দৈনন্দিনতা।

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন কি বাংলাদেশের মেয়েদের অবস্থানও কিছুটা বদলাতে পেরেছে? আমরা তো দেখেছি, শাহবাগের জমায়েতে প্রতি দিনই বহু তরুণীও অংশ নিয়েছেন...

শাহবাগ নিঃসন্দেহে মেয়েদের অগ্রগতির চিহ্ন। সাধারণ মানুষ তো এগিয়েছে। ভাবতে পারো, শাহবাগের জমায়েতে যাবে শুনলে রিকশা চালকও সওয়ারির কাছ থেকে ভাড়া নিতে চাননি। বিনা পয়সায় গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন! কিন্তু এই পরিস্থিতি, এই ঐক্য ধরে রাখা গেল না। তবে, শাহবাগ আন্দোলন মেয়েদের সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন সূচিত করে না। আন্দোলনের তো এক সময়ে সমাপ্তি হয়। আরও আগে সমাপ্তি হলে হয়তো এতটা অনৈক্য দেখা দিত না। আবার এই আন্দোলন আরও এগোলেও হয়তো তা ইতিবাচক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে শেষ হতে পারত।

এখনও শাহবাগে সভা হয়, কিন্তু লোক আর তেমন হয় না। এটা রাজনৈতিক আন্দোলন বা পরিস্থিতিরই ব্যর্থতা।

আওয়ামি লিগ বিগত কয়েক বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লির বোঝাপড়া বেড়েছে। আবার, ইদানীং নানা দ্বিপাক্ষিক প্রসঙ্গে প্রত্যাশিত সমঝোতা না হওয়ায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। কী বলবেন?

আওয়ামি লিগ সরকার ২০০৮-এ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বরাবরই তার কাজের মাধ্যমে দিল্লিকে বোঝাতে চেয়েছে যে, তারা কোনও ভাবেই ভারত-বিরোধিতাকে সমর্থন করে না। সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতার প্রশ্নেও দুই দেশের মধ্যে মিল দেখা গেছে। অথচ, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন বাংলাদেশ গেলেন, বিএনপি নেত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করলেন না। এতে ভারতের তরফে আওয়ামি লিগের প্রতি সমর্থন আরও বেড়েছে।

ভারতের নতুন সরকার বিএনপি-র প্রতি যে মনোভাব নিয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রতিবেশীসুলভ শিষ্টাচার বজায় রেখেছে, বিএনপি নেত্রী দেশের বিরোধী নেত্রী না হলেও ভারতের সফররত নতুন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তাঁর সঙ্গে যে সৌজন্য সাক্ষাত্‌ করেছেন, তা সুলক্ষণ। কিন্তু বিএনপি-র ধারাবাহিক ভারত-বিরোধিতা দুই দেশের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট রাখতে দেবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

এ ক্ষেত্রে ভারতের সম্পর্কে বা আওয়ামি লিগ সরকার সম্পর্কে বিরোধীদের মূল অভিযোগ ঠিক কী?

মূল অভিযোগ এটাই যে দুই দেশের সম্পর্ক কার্যত একতরফা। বাংলাদেশ বহু ভাবে ভারতকে সাহায্য করলেও ঢাকার কোনও প্রত্যাশাই দিল্লি পূরণ করছে না। এবং আওয়ামি লিগ এ ব্যাপারে কিছু করছে না। এতে বাংলাদেশের সরকারের সংকট বাড়বে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের পক্ষেও এটা ভাল হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE