Advertisement
০২ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

ভুল বললেও একটু শুনবেন কমরেড

বামপন্থীরা কথোপকথনের ক্ষমতা উত্তরোত্তর হারিয়ে ফেলেছেন। এর পিছনে কেবল দলীয় শাসন নিরঙ্কুশ রাখার তাড়নাই ছিল না, ছিল নিজস্ব বৃত্তের বাইরে থাকা সমাজের প্রতি মজ্জাগত অবিশ্বাস। স্বভাব বদলাল কি?বামপন্থীরা কথোপকথনের ক্ষমতা উত্তরোত্তর হারিয়ে ফেলেছেন। এর পিছনে কেবল দলীয় শাসন নিরঙ্কুশ রাখার তাড়নাই ছিল না, ছিল নিজস্ব বৃত্তের বাইরে থাকা সমাজের প্রতি মজ্জাগত অবিশ্বাস। স্বভাব বদলাল কি?

বাণী তব ধায়। (বাঁ দিক থেকে) বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস, বক্তৃতারত জ্যোতি বসু। ব্রিগেড, ২০০৬

বাণী তব ধায়। (বাঁ দিক থেকে) বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস, বক্তৃতারত জ্যোতি বসু। ব্রিগেড, ২০০৬

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:২৩
Share: Save:

বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর কথা বলার একটা নিজস্ব ভাষা এবং ভঙ্গি আছে। সাজানো বাগান রসাতলে গেলেও সেটায় টোল পড়েনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তথাকথিত শিল্প সম্মেলন সম্পর্কে তিনি সেই আগমার্কা শৈলীতে মন্তব্য করেছেন: ‘অশ্বডিম্ব পাওয়া গেছে, নাচনকোঁদন হয়েছে, আর কিছু হয়নি। স্টাইল নিজের বটে, কথাটা অবশ্য তিনি একা বলছেন না। পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-বিনিয়োগ নিয়ে দু’দিক থেকে দু’রকম কথা হাওয়ায় ভাসছে। এক দিকে সরকারি বয়ান: ‘দারুণ হচ্ছে’। অন্য দিকে বিবাদী স্বর: ‘কিছুই হচ্ছে না’। সত্য সচরাচর দুই মেরুর মাঝামাঝি বসতি করে।

করুক। কিন্তু চেয়ারম্যানের বক্তব্য শুনে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করে: এটাই আপনাদের সমালোচনা? ব্যস? একটা কমিউনিস্ট পার্টি এর বেশি কিছু ভেবে উঠতে পারল না? প্রশ্নটা হঠাত্‌ মনে এল, এমন নয়। এই তো ক’দিন আগে পার্টির প্লেনাম হল, ব্রিগেডে সংখ্যাগুরু মিটিং জমল অনেক দিন পরে, কথার ফুলঝুরি রংমশালের সঙ্গে দু’চারটে বুড়িমার চকলেট বোমও ফাটল, কিন্তু নতুন চিন্তা? সেই চিন্তা প্রকাশের নতুন ভাষা? খুঁজি খুঁজি নারি। এই বাজারে ভোট-চিন্তা মানেই জোট-চিন্তা, ও নিয়ে খোঁটা দেব না, কিন্তু এতগুলো পাকা মাথা পাঁচ বছরের কর্মহীন অবকাশেও ভেবে উঠতে পারলেন না, অর্থনীতি সম্পর্কে তাঁদের ঠিক কী বক্তব্য? ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে এ বিষয়ে যা শোনা গেল, তার সারমর্ম: তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার শিল্প আনতে পারবে না, কাজ দিতে পারবে না, আমাদের ফিরিয়ে আনুন, আমরা পারব। কথাটা ক’জন বিশ্বাস করবে, সেটা গৌণ ব্যাপার। কিন্তু এক দিকে নির্বাচনী পাটিগণিত আর অন্য দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভুলভ্রান্তি, ব্যর্থতা ও স্বাভাবিক শক্তিক্ষয়— এই দুটি খড়কুটো আঁকড়ে ধরে রাজ্য রাজনীতির বৈতরণিতে ভেসে থাকার করুণ প্রয়াস চলবে? রাজ্য, দেশ এবং দুনিয়ার নতুন বাস্তব বিচার করে পথ খোঁজার তাগিদটুকুও থাকবে না? এ-ই কি সর্বশক্তিমান পার্টির ভবিতব্য ছিল?

এই জিজ্ঞাসা নিয়েই একটি বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলাম। রণবীর সমাদ্দারের লেখা প্যাসিভ রেভলিউশন ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল ১৯৭৭-২০১১ (সেজ)। ২০১৩ সালে প্রকাশিত বইটি আগেও পড়েছি, সংকলনের বেশ কিছু লেখা পড়েছি আরও অনেক আগে। গত কয়েক দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজ বিষয়ে রণবীরদার বহু আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। সজাগ মনের অন্তর্দৃষ্টি এবং বহুমাত্রিক জ্ঞানচর্চায় সমৃদ্ধ সেই সব প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন থেকে নির্বাচিত কিছু লেখার এই সংকলনটি নতুন করে পড়ে দুটো লাভ হল। এক, বামফ্রন্ট জমানা নামক কালপর্বটাকে নানান সময় ও ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভেঙে ভেঙে দেখার এবং সেই দেখার মধ্য দিয়ে স্মৃতিতে শান দিয়ে নেওয়ার একটা সুযোগ মিলল। দুই, সমাজবিজ্ঞানীর বিশ্লেষণের সঙ্গী হয়ে সেই সব ঘটনা এবং তার অন্তর্নিহিত রাজনীতির একটা অর্থ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করা গেল। সম্পূর্ণ অর্থ নিশ্চয়ই নয়, তেমন কিছু আছে বলে বিশ্বাসও হয় না। আবার যে অর্থটা বুঝলাম, লেখক নিজে সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন কি না, তা-ও হলফ করে বলতে পারি না। তাঁর বোঝানো আর পাঠকের বোঝায় বেশি-কম হলে রণবীরদা রাগ করবেন না, সেটা অবশ্য হলফ করেই বলতে পারি। কারণ, তিনি কথোপকথনে বিশ্বাস করেন। নিঃশর্ত কথোপকথন। তার প্রথম ও প্রধান ধর্ম: শুশ্রূষা— শোনার ইচ্ছা। কথা বলা এবং কথা শোনা, দুইই সেই বিনিময়ে সমান মূল্যবান। তাই, যদি ভুল বুঝে থাকি, তবু, ঠিক জানি, তিনি কথোপকথনের দরজা বন্ধ করবেন না, ভুলটাও মন দিয়ে শুনবেন।

পার্টি শোনেনি। বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় যত কায়েম হয়েছেন, সমাজের সঙ্গে কথোপকথনের ক্ষমতা উত্তরোত্তর হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের স্বভাব থেকে শুশ্রূষা ক্রমে লোপাট হয়ে গেছে। রণবীর সমাদ্দার এই বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। সংগত কারণেই। তিনি দেখিয়েছেন, নানা দিক থেকে নানা মত, নানা ক্ষোভ, নানা প্রতিবাদ শোনার এবং খোলা মনে তার উত্তর খোঁজার অনিচ্ছা ও অক্ষমতা কী ভাবে শাসক বামপন্থীদের উত্তরোত্তর দুর্বল করেছে। বিশেষ করে নতুন শতাব্দীর প্রথম এক দশকে দেশ ও দুনিয়ার পরিস্থিতি দ্রুত বদলেছে, পশ্চিমবঙ্গে তার অনিবার্য প্রভাব পড়েছে, সমাজ ক্রমাগত নতুন নতুন দাবি উদ্ভাবন করছে, সেই সব দাবি উত্তরোত্তর জোরদার ভাবে পেশ করছে। বামপন্থীরা তাঁদের দল এবং প্রশাসনের পুরনো কাঠামো দিয়ে সেই দাবি মোকাবিলার চেষ্টা করেছেন এবং ব্যর্থ হয়েছেন। রেশন-দুর্নীতি থেকে সিন্ডিকেট-রাজ, সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী, প্রতিস্পর্ধী মানুষের সঙ্গে শর্তহীন, খোলামেলা আলোচনার প্রয়োজন ছিল, সুযোগ ছিল। শাসক বামফ্রন্ট সেই সুযোগ নেয়নি।

নিতে পারেনি। কারণ খোলামেলা কথোপকথনের সুযোগ নিতে গেলে দলতন্ত্রের পুরনো কাঠামো ভেঙে বেরিয়ে আসতে হত। কথাটা লিখেই মনে হল, ‘দলতন্ত্র’ শব্দটা সম্পর্কে একটু সাবধান হওয়া ভাল। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট যুগে দল সরকারকে গ্রাস করেছে, গণতন্ত্র দলতন্ত্র হয়ে গেছে— এই ছকটা আমাদের চেনা, একটু বেশি মাত্রায় চেনা। একটু বেশি সরলও বটে। রণবীরদা দেখিয়েছেন, ষাটের দশকের যুক্তফ্রন্ট আমলের ‘শিক্ষা’ নিয়ে ‘বিপ্লবের দল’ থেকে ‘শৃঙ্খলার দল’ হয়ে-ওঠা কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৭৭ সালে ক্ষমতা অর্জনের পরে জ্যোতি বসুর পৌরোহিত্যে কী ভাবে সরকারের খোলসে ঢুকে গেল, প্রশাসনিকতা কী ভাবে পার্টিকে গ্রাস করে নিল। হ্যঁা, এই পথেই চৌত্রিশ বছরের অলৌকিক শাসন-সাফল্য। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট তো বাস্তবিকই তার ‘সাফল্যের শিকার’। প্রশাসনিকতার অচলায়তনে বন্দি পার্টি এবং সেই পার্টির কুক্ষিগত প্রশাসন এই দ্বৈতসত্যই শেষ পর্যন্ত অলৌকিক বিপর্যয়ও ডেকে আনল। পড়তে পড়তে মনে হয়, এ যেন এক জোড়া অজগর সাপের গল্প, একটি আর একটিকে গিলতে গিলতে পরিণামটা কী যে দাঁড়াল, সে তারা নিজেরাও আর ঠাহর করতে পারেনি। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পরবর্তী অধ্যায়ে বুদ্ধদেববাবুর মূর্তিতে এমন এক করুণ উদ্ভ্রান্তি নিতান্ত প্রকট হয়ে পড়েছিল। নন্দীগ্রাম ‘পুনর্দখল’-এর পরে মহাকরণে দাঁড়িয়ে তাঁর সেই ‘দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক ইন দেয়ার ওন কয়েন’ শুনে আমরা তাঁকে খুব বকাবকি করেছিলাম বটে, কিন্তু পার্টি ও প্রশাসন একে অন্যের উদরস্থ হলে তো এমনটাই স্বাভাবিক। এবং, অবিস্মরণীয়, তার আগে দীর্ঘ এগারো মাস নন্দীগ্রামের ‘মুক্তাঞ্চল’-এ প্রশাসন পৌঁছতে পারেনি, পার্টি— জনগণের পার্টি— প্রতিবাদীদের সঙ্গে কোনও সংযোগ তৈরি করতে পারেনি, কথোপকথনের কোনও রাস্তাই খুঁজে পায়নি! এই না-পারার তাত্‌পর্য দলনেতারা আজও বুঝেছেন কি? মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে কি?

মানসিকতা এক দিনে তৈরি হয় না, তা হল দীর্ঘ অভ্যাসের পরিণাম। চিন্তা ও আচরণের অভ্যাস। ১৯৮৮ সালে লেখা একটি প্রবন্ধে রণবীর সমাদ্দার পার্টি, গণসংগঠন এবং গণ-আন্দোলনের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, সমাজ-রাজনীতির জমি থেকে উঠে আসা সংগঠন এবং আন্দোলনগুলির সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিকে একটা যথার্থ লেনদেনের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, তাদের নিজস্ব পরিসর দিতে হবে, তাতে পার্টির নিজেরও মঙ্গল। তাঁর কথার সূত্র ধরে বলতে পারি, কেরলের মতো রাজ্যে বামপন্থীরা সেটা অংশত পেরেছেন। পশ্চিমবঙ্গে একেবারেই নয়। এ রাজ্যে সামাজিক আন্দোলন বা অসরকারি সংগঠনের বিকাশ যে অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় অকিঞ্চিত্‌কর, সেটা অহেতুক নয়। সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে এ রাজ্যের ক্ষমতাসীন বামপন্থীরা কোনও যোগসূত্র তৈরি করেননি, করতে চাননি, বরং সর্বশক্তি দিয়ে তেমন যোগসূত্র রচনার সম্ভাবনাকে প্রতিহত করেছেন। এর পিছনে কেবল দলীয় শাসন নিরঙ্কুশ রাখার তাড়নাই ছিল না, তার সঙ্গে ছিল নিজস্ব বৃত্তের বাইরে থাকা বৃহত্তর সমাজের প্রতি এক মজ্জাগত অবিশ্বাস। ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে দক্ষিণ কলকাতার এক সিপিএম নেতার সুগম্ভীর আশ্বাসবাণী এখনও কানে বাজে, কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা আমাদের সম্পর্কে দলতন্ত্রের অভিযোগ করবেন, সেটা আপনাদের বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যমের ধর্ম, কিন্তু ওটা মিথ্যে অভিযোগ, আমরা গণতান্ত্রিক আদর্শ নিয়েই চলি, এই তো, প্রত্যেকটা এলাকায় আমরা লাইক-মাইন্ডেড মানুষদের নিয়ে কমিটি তৈরি করেছি...’ লাইক-মাইন্ডেড মানে ঠিক কী, সেটা তাঁকে আর জিজ্ঞাসা করিনি, কারণ তাঁর কথা শুনেই ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গিয়েছিল।

আশির দশকের শেষের দিকের কথা। কলকাতার দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি পাড়ায় নতুন সংসার পেতেছি। এক দিন সকালে এক তরুণ এসে একটি গণশক্তি দিয়ে গেলেন। তার পর, মাঝে মাঝেই। এক দিন কথায় কথায় বললাম, ‘আপনাদের একটা নাইট স্কুল আছে না? সেখানে আমরা দু’জনে পড়াতে চাই। সপ্তাহে দু’তিন দিন যেতে পারব।’ তিনি বলেছিলেন, ‘এলসি’তে কথা বলে জানাব।’ তার পর থেকে তিনি আর আসেননি, বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যমের খোঁজটা পেয়ে গিয়েছিলেন নিশ্চয়ই। মাঝখান থেকে গণশক্তির লোকসান হয়ে গেল।

এত অবিশ্বাস নিয়ে কথোপকথন শুরুও করা যায় না। পার্টি কি সেটা কিছুটা বুঝেছে? নায়কদের কারও কারও কণ্ঠস্বরে অন্যের কথা শোনার অভিলাষ ব্যক্ত হচ্ছে। কিন্তু তার কতটুকু মানসিকতার পরিবর্তন, আর কতটা নেহাত ঠেকায় পড়ে রামনাম, বলা কঠিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE