বিদেশ নীতির উপর দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ছায়াপাত ঘটিলে বিস্ময়ের কারণ নাই। কিন্তু ছায়াটিকে চালিকাশক্তি ভাবিলে বড় ভুল হইতে পারে। ভারতে নিযুক্ত পাক রাষ্ট্রদূত কাশ্মীরের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হুরিয়ত নেতাদের সহিত কথা বলিয়াছেন, এই অপরাধে পাকিস্তানের সহিত বিদেশ সচিব পর্যায়ের আলোচনা রদ করিয়া নরেন্দ্র মোদীর সরকার যে ‘জাতীয়তাবাদী কঠোরতা’ প্রদর্শন করিয়াছে, আসন্ন বিধানসভা ভোটের প্রচারপর্বে, বিশেষত জম্মুর উর্বর জমিতে ভারতীয় জনতা পার্টি তথা সঙ্ঘ পরিবারের প্রচারকবৃন্দ তাহার সুফসল তুলিতে যত্নবান হইবেন, ইহা প্রায় অবধারিত। অধিকন্তু, এই নির্বাচনী কৌশলটি প্রয়োগ করিবেন বলিয়াই যদি মোদী আলোচনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত স্থির করিয়া থাকেন, তাহাও অস্বাভাবিক কিছু নহে— কূটনীতির দাবা খেলায় ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ পদক্ষেপই দস্তুর, পরবর্তী পর্বের সম্ভাব্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলি ভাবিয়াই খেলিতে হয়। কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিই ভারতের এই আচরণের একমাত্র কারণ, এমন সিদ্ধান্ত যুক্তিসম্মত নয়। নরেন্দ্র মোদী যে কঠোর এবং আবেগবর্জিত ভাবমূর্তি বিপণন করিয়া ভোটে জিতিয়াছেন, তাঁহার জমানার প্রথম তিন মাসে সেই ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার যে প্রয়াস লক্ষ করা গিয়াছে, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় দিলে কথা বলিব না’ ঘোষণা তাহার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ। অর্থাৎ, ঘোষণাটি আকস্মিক হইতে পারে, কিন্তু অপ্রত্যাশিত বা অসঙ্গত বলা চলে না।
সত্য, ইসলামাবাদের কর্তা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা হুরিয়তের নেতাদের সহিত গত দুই দশক যাবৎ অনেক বার কথা বলিয়াছেন, দিল্লি তাহা মানিয়া লইয়াছে। এমনকী অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলেও। সুতরাং নরেন্দ্র মোদী দুই দশকের ঐতিহ্য ভাঙিয়াছেন। কিন্তু তিনি বলিতেই পারেন, ঐতিহ্য ভাঙিবার নিদর্শন কেবল যোজনা কমিশনের গণ্ডিতে সীমিত থাকিবে কেন? এবং ঐতিহ্য ভাঙিবার যুক্তিও এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট। ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই কাশ্মীর সমস্যার মোকাবিলা করা দরকার, দুই দেশের মধ্যে একাধিক চুক্তিতেও দ্বিপাক্ষিকতার শর্তই স্বীকৃত। হুরিয়তের সহিত ইসলামাবাদের আলোচনা সেই শর্তের পরিপন্থী, বিশেষত এই কারণে যে হুরিয়ত আপন বিচ্ছিন্নতাবাদী অবস্থান পরিত্যাগ করে নাই। তাহা সত্ত্বেও ভারতীয় রাষ্ট্র বৃহত্তর বিবেচনাবোধের প্রেরণায় তাহাদের সহিত পাকিস্তানের আলোচনা মানিয়া লইতে পারে, এত দিন তাহাই লইয়াছে। কিন্তু কাশ্মীর সমস্যাকে আপন ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহার করিবার কৌশল পাকিস্তান এখনও ছাড়ে নাই, ভারতে সীমান্ত-অতিক্রমী সন্ত্রাস বন্ধ করিবার ব্যাপারেও ইসলামাবাদ-রাওয়ালপিন্ডির সদিচ্ছার যথেষ্ট প্রমাণ মেলে নাই, বরং হাফিজ সইদ আদি প্রশ্নে অসহযোগিতাই প্রকট। সুতরাং ভারতের কঠোর হইবার যুক্তি আছে। নরেন্দ্র মোদী সেই যুক্তি অনুসরণ করিয়াছেন। ফোঁস করিয়াছেন।
ইহার ফলে কি দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কে অবনতি হইবে? আলোচনার পথ রুদ্ধ হইয়া যাইবে? ইসলামাবাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া তেমন সংকেত দেয় না। পাক রাষ্ট্রদূত বরং শান্তিপ্রক্রিয়া চলমান থাকিবে বলিয়া আশা প্রকাশ করিয়া ইঙ্গিত করিয়াছেন, তাঁহার রাষ্ট্র মোদীর সিদ্ধান্ত লইয়া কূটনীতির দুনিয়ায় শোরগোল তুলিতে চাহে না। চাহিলেও বিশেষ সুবিধা হইবে না— ওবামা অথবা শি চিনফিং, কেহই ভারত-পাকিস্তান সমীকরণে বড় রকমের অস্থিরতা চাহেন না। তদুপরি, মোদী বলিতেই পারেন, তিনি ক্ষমতায় আসিয়াই সহযোগিতার হাত বাড়াইয়াছিলেন, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পাঠাইয়া কিঞ্চিৎ বেশিই বাড়াইয়াছিলেন, কিন্তু এক হাতে তো করমর্দন হয় না। আপাতত কূটনীতির দাবায় তিনি আড়াই পা অগ্রসর হইয়াছেন। ভুল চাল, বলা চলিবে না। ভাল চাল? ক্রমশ প্রকাশ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy