Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

মৎস্য অবতার

প্রবল বৃষ্টিতে চেন্নাই যখন জলমগ্ন, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং পথে নামিয়া বন্যাত্রাণ পরিদর্শন করিতেছেন বা দুর্জনের মতে পরের বৎসরের নির্বাচনের ভোট জোগাড় করিতেছেন, তখনই এক অপ্রত্যাশিত প্রান্ত হইতে জলে নৌকা ভাসিল। ‘ওলা’ নামক মোবাইল অ্যাপ-নির্ভর ট্যাক্সি সংস্থা যে তাহাদের মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেই জলমগ্ন রাস্তায় নৌকা ডাকিবার সুবিধা করিয়া দিতে পারে, তাহা পূর্বে আঁচ করা যায় নাই।

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৫ ০০:১৫
Share: Save:

প্রবল বৃষ্টিতে চেন্নাই যখন জলমগ্ন, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং পথে নামিয়া বন্যাত্রাণ পরিদর্শন করিতেছেন বা দুর্জনের মতে পরের বৎসরের নির্বাচনের ভোট জোগাড় করিতেছেন, তখনই এক অপ্রত্যাশিত প্রান্ত হইতে জলে নৌকা ভাসিল। ‘ওলা’ নামক মোবাইল অ্যাপ-নির্ভর ট্যাক্সি সংস্থা যে তাহাদের মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেই জলমগ্ন রাস্তায় নৌকা ডাকিবার সুবিধা করিয়া দিতে পারে, তাহা পূর্বে আঁচ করা যায় নাই। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলিতেছেন, এই নৌকায় শহরবাসীর বিস্তর সুবিধা হইয়াছে। অনুমান করা চলে, নিছক পরার্থপরতায় অনুপ্রাণিত হইয়া সংস্থাটি এই অ-পূর্ব কাজটি করে নাই। তাহার পিছনে শক্তপোক্ত ব্যবসায়িক যুক্তি আছে। জলবন্দি শহরবাসীকে নৌকা পরিষেবা দেওয়ায় তাহাদের যতটুকু আর্থিক লাভ হইয়াছে, তাহা তুলনায় নগণ্য। এই কাজটির মাধ্যমে সংস্থা যে বিপুল প্রচার পাইল, এবং যে সুনাম অর্জন করিল, সেই লাভ টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা কঠিন। সেই লাভই এই ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তের চালিকাশক্তি। ঘটনাটি ওলা এবং চেন্নাইবাসী, উভয়ের পক্ষেই লাভজনক হইয়াছে। যে খেলায় একই সঙ্গে উভয়পক্ষই জিতিতে পারে, সেই খেলাকে স্বাগত না জানাইবার কোনও কারণ নাই।

নোয়ার নৌকার কথা তুলিলে নরেন্দ্র মোদী-কথিত বুদ্ধ-গাঁধীর দেশে অধুনা কাহারও ভাবাবেগে আঘাত লাগিতে পারে। অতএব শুদ্ধ, দেশি মহাভারতের শরণ লওয়া ভাল। মৎস্য অবতারে ভগবান বিষ্ণু মনু ও সপ্তর্ষিকে মহাপ্রলয় হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন। একটি বৃহৎ নৌকাতেই। অবশিষ্ট বিশ্ব ধ্বংস হইবার পর ভগবান স্বরূপ প্রকট করিয়া মনুকে জানান, তাঁহার হইতেই অতঃপর সুর, অসুর ও মানুষের সৃষ্টি হইবে। চেন্নাইয়ের জলমগ্ন রাস্তায় নৌকাটি যে পাঠাইয়াছে, ওলা নামক সংস্থাটি তাহার এক অবতারমাত্র। প্রেরকের প্রকৃত নাম ধনতন্ত্র। বাজার ব্যবস্থা। অ্যাডাম স্মিথ যে বাজারের কথা বলিয়াছিলেন। কষাইয়ের মাংস কাটার পিছনে মানুষের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করিবার পরার্থপরতার ভূমিকা যতখানি, ওলার নৌকা ভাসাইবার পিছনে জলমগ্ন মানুষকে উদ্ধার করিবার তাগিদ তাহার অধিক বলিয়া বোধ হয় না। কিন্তু, বাজারের অদৃশ্য হাত আসিয়া সেই নিতান্ত স্বার্থকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তটি হইতেই অপর পক্ষের উপভোগ বা উপকার নির্মাণ করিয়া দেয়। ইহাই বাজার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। সৌন্দর্যও বটে। নৌকা নামাইবার জন্য রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার প্রয়োজন হয় নাই, মুখ্যমন্ত্রীর তৎপরতারও নহে। বাজার সুযোগ তৈরি করিয়া দিয়াছে, ওলা সেই সুযোগ কাজে লাগাইয়াছে। বাজার এই ভাবেই চলে। ভারতের নেতারা অতীতেও সেই চলন বুঝিতে পারেন নাই, আজও পারেন না, তাহা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

মৎস্য অবতারের কাহিনিটি আরও এক অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ। সপ্তর্ষি ভিন্ন শুধু মনুরই প্রাণ বাঁচাইয়াছিলেন মৎস্য অবতার। সেই মনু হইতেই যেমন সুরের জন্ম, তেমন অসুরেরও। বাজার ব্যবস্থার ভাসাইয়া দেওয়া নৌকাটিও তেমন। সেই নৌকা হইতেও অসুর জন্মায়। তাহাতে নৌকার মহিমা কমে না, কিন্তু সুর ও মানুষের দায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। অসুরের বিরুদ্ধে, অশুভের বিরুদ্ধে লড়াই করিয়া জিতিতে পারাই বিবর্তনের প্রধানতম শর্ত। বাজারেও অসুরের বিরুদ্ধে লড়িতে হইবে। সেই অসুর বাজারসঞ্জাত, কিন্তু তাহা বাজারের পক্ষেও ক্ষতিকারক। সেই অসুরের কারণে বাজারকে ত্যাগ করা চলে না। বরং, বাজারের স্বার্থেই সেই অসুর বধ করা প্রয়োজন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE