প্রধানমন্ত্রী মোদী ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করিয়া দিয়াছেন যে তিনি অপরাপর প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রধান নেতা হইতে একটি জায়গায় রীতিমত পৃথক। তিনি যাহা করেন, ভুল হউক ঠিক হউক, প্রবল স্পষ্টতার সহিত করেন। সকল দিক, এমনকী দুই দিক রাখিয়া কাজ করিবার (কু)অভ্যাস তাঁহার নাই। সুতরাং লালকৃষ্ণ আডবাণীর শেষ আশার স্ফুলিঙ্গটিও বরফজল ঢালিয়া নিবাইয়া দেওয়া হইল। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব কালচারাল রিলেশনস-এর যে শীর্ষ পদটির দিকে আডবাণীর নজর ছিল, পদটি যে তাঁহার পাইবার সম্ভাবনাই নাই, এই সিদ্ধান্ত হইল। কেবল আডবাণী নহেন, মুরলীমনোহর জোশীর কপালেও একই গতি। দলের অভিভাবক পদ হইতে তাঁহারা দুই জনেই আপাতত চ্যুত। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের মতে, তরুণতর প্রজন্মকে তুলিয়া আনিবার ইহাই প্রকৃষ্ট পন্থা। আডবাণী যেহেতু ইদানীং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রিয়পাত্র নহেন, বর্ষীয়ান নেতাদের বিদায় জানাইবার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত তাই নাগপুরের দ্রুত সিলমোহর। ইতিপূর্বে আডবাণী যখন স্পিকার হইবার বাসনা প্রকাশ করিয়াছিলেন, তখনও এমন নীরবে এবং ত্বরিতে সে বাসনা অচরিতার্থ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। মোদী যথেষ্ট আটঘাট বাঁধিয়া নিশ্চিত করিতেছেন যাহাতে দলের মহীরুহদের কর্তনক্ষণে তেমন বিতর্ক না হয়। দলের অন্দরবাহিরে অবশ্যই গুঞ্জন চলিতেছে, ইহা কি কেবলই বানপ্রস্থ, না কি রাজনৈতিক হিসাব চুকাইবার খেলা। তবে এই সব গুঞ্জনের আয়ু মাসাধিক কালের বেশি নয়, মোদী আডবাণী সকলেই জানেন।
দুর্ভাগ্য এই যে, পুরাতন প্রজন্মকে বাদ দিবার সময় যে রাজনীতির প্রকট প্রকাশ, নূতন প্রজন্মকে আনিবার মধ্যেও তাহাই। আডবাণী বা জোশী যদি শারীরিক অক্ষমতার জন্য সংস্কৃতি মণ্ডলের প্রধান পদের অনুপযুক্ত হইয়া থাকেন, কেবল বয়স কম হইবার জন্যই কোনও বলিউড তারকা তাঁহাদের অপেক্ষা যোগ্যতর প্রার্থী হইবেন, এই যুক্তি মানিয়া লওয়া কঠিন। অথচ কিরণ খের বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য ও অভিনেত্রী, ইহা ব্যতীত তাঁহার ‘যোগ্যতা’র অন্য কোনও হেতু নাই। ভারতের মতো বহুধর্মী বহুমুখী দেশের সংস্কৃতি উপদেষ্টার কাজটি এত সহজ নয় যে, কেবল অভিনেত্রী হইবার সুবাদেই তাহার হাল ধরা যায়। অথচ দেশীয় সংস্কৃতি জগতের বিষয়ে কোনও ওয়াকিবহাল ব্যক্তি আইসিসিআর-এর শীর্ষপদটিতে থাকিলে পদ ও সংস্থার চরিত্রই পাল্টাইয়া যাইত, সংস্কৃতি জগতেরও কিছু উপকার হইত।
অবশ্য মোদী সরকার একা নয়, কোনও সরকারই সাম্প্রতিক কালে এমন সুবিবেচনার পরিচয় দেখাইয়াছে কি না সন্দেহ। বর্তমান ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইহাই সমস্যা। বাম, কংগ্রেস, বিজেপি কিংবা আঞ্চলিক দলসমূহ: সকলেরই ভাবখানা এই যে, প্রতিষ্ঠানসমূহ তাহাদের রাজনৈতিক হিসাব মিটাইবার জন্যই অস্তিত্বশীল। তাহারা পুরস্কার বিলাইবে ও তিরস্কার নির্ধারণ করিবে, ইহা ভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলির অন্য আদর্শ-উদ্দেশ্য নাই। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে হয়তো পরিস্থিতি কিছু আলাদা ছিল, কিন্তু যুগ যত পাল্টাইতেছে, প্রতিযোগিতার মাত্রা বাড়িতেছে, মান কমিতেছে। এখন সর্বঘটে বেলপাতা দিয়া নিজের পূজাতেই সিদ্ধি। বেশি কথায় কাজ কী, পশ্চিমবঙ্গেও সেই নির্লজ্জ দলতান্ত্রিকতার চর্চা। প্রতিটি সরকারি ও আধা-সরকারি সংস্থায় বিশেষজ্ঞ কিংবা বেশি যোগ্যদের বাদ দিয়া দলদাসদের রমরমা চলিতেছে। এমতাবস্থায় নেতার অপ্রিয় পদপ্রার্থীর বয়স যদি সত্যই আশি-ঊর্ধ্ব হয়, তাঁঁহার ‘যোগ্যতা’ লইয়া তর্কে-বিতর্কে লাভ কী। যথাসত্বর তাঁহাকে বানপ্রস্থের মহিমা বুঝাইয়া দেওয়া হইবে, তাহাই তো স্বাভাবিক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy