আমি তোমাদেরই লোক মর্মে যাঁহাদের নাম খ্যাত নহে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্ভবত তাঁহাদের দিকে তাকাইবে না বলিয়াই মনস্থ করিয়াছে। দলতন্ত্রের প্রেক্ষিতে জরুরি সিদ্ধান্ত। কালীঘাটের প্রতি যাঁহাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত নহে, তাঁহাদের লইয়া বড় মুশকিল। মীরা পাণ্ডেই যেমন। অতএব, শাসকরা আর ঝুঁকি লইতে চাহেন না। মানবাধিকার কমিশনে নপরাজিত মুখোপাধ্যায় বসিয়াছেন, মহিলা কমিশনে দোলা সেন। যে প্রতিষ্ঠানগুলির মাহাত্ম্যই তাহাদের নিরপেক্ষতা এবং স্বতন্ত্রতার মধ্যে নিহিত, সেই প্রতিষ্ঠানগুলিতে দলতন্ত্রের আসন পাতার কাজটি প্রায় সম্পূর্ণ হইয়াছে। নির্বাচন কমিশনার রূপে সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের মনোনয়ন এই দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কেতাবেরই আর একটি অধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকার প্রমাণ করিয়াছে, বামফ্রন্ট মরিতে পারে, তাহার ঐতিহ্য অবিনশ্বর। দলের রং বদলাইয়াছে, দলতন্ত্রের মহিমা প্রশ্নাতীত। আগে চক্ষুলজ্জার বালাইটুকু ছিল, এই আমলে তাহারও প্রয়োজন ফুরাইয়াছে।
সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় আইনত রাজ্য নির্বাচন কমিশনের প্রধান পদে আসীন হওয়ার যোগ্য, সন্দেহ নাই। ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকায় আইন বদলাইয়াছে। রাজ্যের সিভিল সার্ভিস অফিসাররাও এই অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিতে পারেন। কিন্তু যাহা আইনসঙ্গত, তাহাই কি নৈতিক? রাজ্যের নির্বাচন কমিশনারের পদে অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার নিয়োগের প্রথা হইতে, নূতন আইন প্রবর্তিত হওয়ার পরও, প্রায় কোনও রাজ্যই সরিয়া আসে নাই। প্রথাটি শুধু প্রথা হিসাবেই পালনীয় নহে, তাহার বাস্তব গুরুত্ব আছে। প্রথমত, ডব্লিউবিসিএস-এর ন্যায় রাজ্য সিভিল সার্ভিসের অফিসাররা চাকরিজীবনের অন্তত একটি বড় অংশ উচ্চতর অফিসারের নির্দেশ পালনের কাজই করেন। আইএএস অফিসাররা যেমন একেবারে প্রাথমিক পর্যায় হইতেই সিদ্ধান্ত করিবার অধিকারী, ডব্লিউবিসিএস অফিসাররা তাহা নহেন। সুশান্তরঞ্জনবাবুর ন্যায় অনেক অফিসারই চাকুরিজীবনের অন্তিম লগ্নে পৌঁছাইয়াও স্বাধীন ভাবে দফতর পরিচালনার দায়িত্ব পান না। যাঁহাদের নেতৃত্বের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা নাই, তাঁহারা গোটা রাজ্যের নির্বাচন পরিচালনা করিবেন কোন জাদুতে? সুশান্তরঞ্জনবাবু চাকুরিজীবনের প্রায় শেষে আসিয়া জেলাশাসকের পদমর্যাদার ঈষৎ ঊর্ধ্বে উঠিয়াছিলেন। নির্বাচন কমিশনার হইয়া মুখ্যসচিবকে তলব করা বা নির্দেশ দেওয়ার কাজটি তাঁহার পক্ষে গুরুভার হইবে না কি? বহু ধাপ নীচের এক অফিসারের নির্দেশ মানিতে মুখ্যসচিবদেরই বা কেমন লাগিবে, সে প্রশ্ন না হয় মুলতুবি থাকুক।
আইনের ফাঁক গলিয়া সুশান্তরঞ্জনবাবুকে এই গুরুদায়িত্ব কেন দেওয়া হইল, সেই কারণটি হয়তো অনুমানযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা আর মীরা পাণ্ডে উপাখ্যানের পুনরাবৃত্তি চাহেন না। বস্তুত, আইনে না ঠেকিলে টালিগঞ্জের কোনও আধা-তারকাও এই পদটি পাইতে পারিতেন বলিয়া আশঙ্কা হয়। শাসক দল সম্ভবত আশা করিতেছে যে নূতন নির্বাচন কমিশনার তাঁহার প্রাপ্যের অধিক প্রাপ্তি লইয়া এমনই বিগলিত থাকিবেন, কোনও অনাচারেই টুঁ শব্দটি করিবেন না। নির্বাচন কমিশন বশে থাকিলে তাহার সুবিধা কতখানি, সাম্প্রতিক অসুবিধায় শাসকরা তাহা বিলক্ষণ বুঝিয়াছেন। অনুমান করা চলে, শাসকদের সেই ‘দুঃস্বপ্নের’ পুনরাবৃত্তি হইবে না। অতঃপর, আশংকা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ন্যায় রাজ্যের নির্বাচনগুলিও প্রহসনে পরিণত হইবে। পশ্চিমবঙ্গের মৃতদেহের উপর দলতন্ত্রের শবসাধনা চলিতেছে, চলিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy