Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

যারা যন্ত্র ছিল, তারাই এখন যন্ত্রী হয়েছে

যে কোনও নির্বাচনে যেন তেন প্রকারেণ জয় চাই, কারণ একটি ভোটে জয়পরাজয় লক্ষ কোটি টাকার হিসেবের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই লুম্পেন রাজনীতিক সাধারণ ভোটারের উপর আস্থা রাখার ঝুঁকি নিতে নারাজ।গত ৩ অক্টোবর বিধাননগর, আসানসোল ও বালি পুরসভা নির্বাচনে গণতন্ত্রের সম্মান যে ভাবে আর এক বার ভূলুন্ঠিত হল তাকে নিন্দা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া দুরূহ। গত এপ্রিলে পুর নির্বাচনেও শাসক দলের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র হত্যার অভিযোগ উঠেছিল, নাগরিক সমাজের একাংশ শাসক দলের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। আজও তাঁরা শাসকের কড়া সমালোচনা করছেন। এবং রাজ্যের কিছু মন্ত্রী এতে গণমাধ্যম ও বিরোধীদের মধ্যে ‘শাসকবিরোধী আঁতাঁত’ খুঁজে পাচ্ছেন!

প্রতিবাদ। কলকাতা, ৫ অক্টোবর। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

প্রতিবাদ। কলকাতা, ৫ অক্টোবর। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

মইদুল ইসলাম
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

গত ৩ অক্টোবর বিধাননগর, আসানসোল ও বালি পুরসভা নির্বাচনে গণতন্ত্রের সম্মান যে ভাবে আর এক বার ভূলুন্ঠিত হল তাকে নিন্দা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া দুরূহ। গত এপ্রিলে পুর নির্বাচনেও শাসক দলের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র হত্যার অভিযোগ উঠেছিল, নাগরিক সমাজের একাংশ শাসক দলের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। আজও তাঁরা শাসকের কড়া সমালোচনা করছেন। এবং রাজ্যের কিছু মন্ত্রী এতে গণমাধ্যম ও বিরোধীদের মধ্যে ‘শাসকবিরোধী আঁতাঁত’ খুঁজে পাচ্ছেন!

প্রশ্ন হল, এই রাজ্যে বিরোধীরা বিভক্ত ও সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও কেন বার বার বর্তমান শাসক দলের বিরুদ্ধে অবাধ নির্বাচনে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠছে? এই বিষয়ে পূর্বতন শাসক দল তথা প্রধান বিরোধী জোটের রেকর্ড খুব একটা ভাল নয়। কিন্তু বর্তমান শাসক দল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কয়েকটি নতুন উপাদান যোগ করেছে। সেটা বিশ্লেষণ করতে গেলে শাসক দলের রাজনৈতিক চরিত্র অনুধাবনের চেষ্টা প্রয়োজন। সে জন্য শুধু তাদের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক অবস্থান বদলানোর ইতিহাস বিচার করলেই হবে না, তাদের রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত্তি ও তার সঙ্গে রাজ্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বও বোঝা দরকার। রাজ্যে কংগ্রেস থেকে উদ্ভূত এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি যাদের মূল জনভিত্তি হল লুম্পেন শ্রেণি। বাকি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণিগুলো (শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি) এ দলকে সব সময় সমর্থন করেনি। আবার এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে শাসক দলের উপরের সারির নেতৃত্ব প্রায় পুরোটাই কলকাতা শহর কেন্দ্রিক এবং অনেকেই পাড়ার ক্লাব রাজনীতি বা দাদাগিরি গোছের বাহুবলী রাজনীতি করে এসেছে। তাদের গ্রামে রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা কম। কয়েক বছর আগে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তারা প্রথম বার গ্রামে একটা বড় জনসমর্থন খুঁজে পেয়েছিল। সেই জনসমর্থনকে রাজ্য সরকার বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু এক দিকে জনগণের করে পুষ্ট সরকারি টাকা ও অন্য দিকে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে লুম্পেন শ্রেণির তোলাবাজির টাকার ভাগ নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আগামী দিনে শাসক দলের জনসমর্থন হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনাকে ত্বরান্নিত করতে পারে।

শাসক দলের সঙ্গে তথাকথিত চিটফান্ডের মূল পান্ডাদের সরাসরি যোগাযোগ, আর্থিক লেনদেন ও প্রতারক সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার গুরুতর অভিযোগ এখন সবাই জানে। এ হেন অপকর্ম ও আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে শাসক দলের মন্ত্রী ও সাংসদ কারাগারে দিন অতিবাহিত করছেন। সেই মন্ত্রী জেলে থেকেও আজ অবধি মন্ত্রিত্ব হারাননি। লজ্জার মাথা খেয়ে কলকাতায় ‘তোমার আসন শুন্য আজি, হে বির পূর্ণ করো’ মার্কা পোস্টার পড়েছে পরিবহণমন্ত্রীকে নিয়ে। রাজ্যের ইতিহাসে এর আগে এ রকম কোনও নজির নেই। সম্প্রতি আদালতে শাসক দলের এক বিধায়ক লোহা চুরির দায়েও দোষী বলে প্রমাণিত। শাসক দলে ভদ্র মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু গুণী অধ্যাপক ও শিল্পী আছেন যাঁরা অনেকে সাংসদ বা রাজ্যের মন্ত্রী, কিন্তু তাঁদের কথায় শাসক দল চলে না। দলের নেতৃত্ব ভাল করেই জানেন যে পঞ্চায়েত বা পুরসভায় যদি লুম্পেন রাজনীতিকদের বাড়াবাড়ি করতে দিয়ে জয় সুনিশ্চিত করতে না পারা যায় তা হলে বিধানসভা বা লোকসভার মতো বড় নির্বাচনে ওই লুম্পেন বাহিনীদের নির্বাচনী কাজে লাগানো যাবে না। লক্ষণীয়, এই রাজ্যে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে বামেদের বরাবর জনসমর্থন আছে, যদিও ২০০৬ সালের পর থেকে সেই জনভিত্তি অনেকটা ক্ষীণ। কংগ্রেসের পিছনে মধ্যবঙ্গে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের তাৎপর্যপূর্ণ সমর্থন আছে। ভারতের রাজনীতিবিশারদরা বিজেপিকে সামাজিক ভাবে রক্ষণশীল এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে ‘বানিয়া পার্টি’ বলে চিহ্নিত করেন। এই রাজ্যেও বিজেপির সব থেকে স্থায়ী জনসমর্থন অবাঙালি ব্যবসায়ীদের মধ্যে।

রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের উপরের সারির অনেক নেতানেত্রীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় সত্তরের দশকে সঞ্জয় গান্ধীর লম্ফঝম্প করা নব কংগ্রেসের আমলে। ভারতের রাজনীতিতে বড় ধরনের লুম্পেনিকরণের প্রবণতা সেই সময় থেকে দেখা গিয়েছিল। পরবর্তী কালে বাম ও গত সাড়ে চার বছরের তৃণমূল আমলে শিল্পক্ষেত্রে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের তুলনায় অন্যান্য রাজ্যের থেকে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমে পিছিয়ে পড়ায় এই লুম্পেন শ্রেণির বহর বাড়তে থাকে। তার মূল কারণ হল সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের অভাব। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো এই শ্রেণি তাই বিভিন্ন ধরনের বেআইনি ও অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যেহেতু এরা আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তাই পুলিশ এবং আইন রক্ষাকারী যে কোনও সংস্থার সঙ্গে তাদের স্বভাবতই বিরোধ থাকে। এ কথা তাই ভুলে গেলে চলবে না যে রাজ্যে ‘পরিবর্তন’-এর পরে লাগামহীন হারে এই শ্রেণির হাতে পুলিশ বার বার আক্রান্ত হচ্ছে। রাজ্যের শাসক দল প্রায়শই নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে আদালতকে পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। বহু সময় তারা সাংবিধানিক রীতিনীতি মানছে না। আইনের শাসনের বদলে নৈরাজ্য কায়েম হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে শাসক দলের ‘সম্পদ’রা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণির (শিক্ষক, ডাক্তার, সাংবাদিক ইত্যাদির) উপরে আগ্রাসী আক্রমণ নামিয়ে আনছে। বললে খুব অত্যুক্তি হবে না যে, রাজ্যের বর্তমান শাসক দল হল উচ্চবর্ণ মধ্যবিত্ত ভদ্র শ্রেণির বিরুদ্ধে লুম্পেন শ্রেণির বিদ্রোহ।

এই শ্রেণি সত্তরের দশকে কংগ্রেস জমানায় ও পরে চৌত্রিশ বছরের বাম আমলে ভদ্রলোক রাজনীতিকদের হাতে চালিত হত। কিন্তু এরা এখন আর তাঁদের হয়ে নির্বাচনে খাটে না, স্বাবলম্বী হয়ে নিজেই রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছে। অন্য দিকে চাকরি ও কাজের অভাবে রাজনীতি একটা নতুন পেশা হয়ে গেছে। এ হেন সন্ধিক্ষণে পশ্চিমবঙ্গে আবাসন শিল্পের রমরমা আর তার সঙ্গে যুক্ত ‘সিন্ডিকেট রাজ’ এবং ‘তোলা রাজ’ এখন বঙ্গীয় রাজনীতির নতুন বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই যে কোনও নির্বাচনে যেন তেন প্রকারেণ জয় দরকার, কারণ একটি ভোটে জয়পরাজয় লক্ষ কোটি টাকার হিসেবনিকেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই লুম্পেন রাজনীতিক সাধারণ ভোটারের উপর আস্থা রাখার ঝুঁকি নিতে অস্বীকার করে। অন্য দিকে ‘মাওবাদী’ কায়দায় পুলিশকে বোমা মারার হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও শাসক দলের ‘ভাল সংগঠক’ বহাল তবিয়তে ঘুরেই বেড়ায় না, বিরোধীদের আরও হিংস্র হুঁশিয়ারি দেয়। শাসক দলের অনেক সাংসদ, মন্ত্রী ও বিধায়কের মুখে এ হেন ভাষা, আস্ফালন, হুমকি উচ্চারিত হচ্ছে যা ‘ভাষা সন্ত্রাস’ বলে অভিহিত হচ্ছে। এই ‘ভাষা সন্ত্রাস’ প্রতিযোগিতার তাড়নায় মাঝে মাঝে বিরোধী নেতাদেরও গ্রাস করেছে।

এমতাবস্থায় পুলিশের যখন শাসক দলের ‘দলদাসে’ পর্যবসিত হওয়ার অভিযোগ ওঠে, তখন রাজ্যের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ থাকে। পুলিশ যদি এই আচরণই করতে থাকে, তা হলে ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষও যে পুলিশকে মানবে না, এমন ভয় অমূলক নয়। গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মানুষ, গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ একজোট হয়ে সে রকম ভয়ানক পরিণতিকে রুখতে পারেন।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE