দৈ নন্দিন জীবনে কী করে বেদান্ত দর্শন পালন করতে হয়, তা নিয়ে অনেকে অনেক কিছু বলে-লিখে গিয়েছেন। কিন্তু করে দেখাল তৃণমূল কংগ্রেস।
বেদান্তের মূল কথা অধ্যাস। যেটা যা নয়, তাকে তা-ই বলে দেখা। সাপ আছে মনের মধ্যে, তাকে আপনি আরোপ করছেন দড়ির ওপর। রজ্জুতে সর্পভ্রম। ‘সত্য’ বলে যা ধরে নিই, তা যে আসলে যে ভ্রম, তা টের পাওয়াটাই হল চ্যালেঞ্জ।
তৃণমূলের শাসনের চার বছরে রাজ্যবাসী সেই চ্যালেঞ্জ প্রায় জিতে গিয়েছে। যা হয় তা নয়, এমনটা বিশ্বাস করতে কাউকে তেমন হোঁচট খেতে হয় না আর। সেই পার্ক স্ট্রিটে যে পুলিশ বলল, ‘কিছু একটা হয়েছে’ আর মুখ্যমন্ত্রী বললেন কিছুই হয়নি, সেখান থেকে বেদান্ত প্র্যাকটিসের শুরু। তার পর থেকে এই এখন পর্যন্ত, যখন মিছিল, ঘেরাও, মন্ত্রীদের ডেপুটেশনের জেরে পদত্যাগ করলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়, মনে হয়েছিল, চাপে পড়ে বুঝি। পরে স্পষ্ট হল, মন্ত্রীদের সান্নিধ্যে কমিশনার আসলে ‘চাপমুক্ত’ হচ্ছিলেন। টিভিতে পষ্ট দেখলেন— উন্মুক্ত অস্ত্র হাতে দুষ্কৃতীরা ছুটে আসছে ভোটারদের দিকে, কিন্তু সেটা বিভ্রম। নির্বাচন হয়েছে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ। যাকে মনে হচ্ছে শাসক দলের দুষ্কৃতী, সে আসলে বিরোধী। যাকে ভেবেছেন নির্যাতিত, সে আসলে অপরাধী। যাকে দেখা যাচ্ছে ঘুরে বেড়াতে, আসলে সে পলাতক। যারা পিস্তল হাতে তৃণমূলের মিছিলে নাচে, তারা টিভি চ্যানেলের লোক। আর গলায় পাশ-ঝোলানো টিভি চ্যানেলের যে সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গিয়ে মার খায়, তারা বহিরাগত।
বড়-ছোট গুলিয়ে যাওয়াটাও এক রকম মায়া। শ্রীরামকৃষ্ণদেব যেমন বুঝিয়েছিলেন, সূর্যটা আসলে অনেক বড়, কিন্তু মনে হয় যেন বুড়ো আঙুলটিতেই ঢাকা পড়ে যায়। তেমনই এখন বুঝি, ছাত্রদের হাতে শিক্ষকের নিগ্রহ মস্ত বিপত্তি বলে মনে হলেও, আসলে ছোট ঘটনা। উল্টোটাও হয়। যদি কেউ ফেসবুকে কার্টুন পোস্ট করে নেতাদের বিদ্রুপ করে, দেওয়াল-লিখনে ব্যঙ্গ-ছড়া লেখে, মনে হয় এ আর এমন কী বড় ব্যাপার। অচিরে স্পষ্ট হয়, এ হল মস্ত ব্যাপার। থানা-পুলিশ তো হবেই, দেশদ্রোহিতার মামলায় জেলে পচেও মরতে হতে পারে।
এই যে ইন্দ্রিয়-বুদ্ধি-মনের সাক্ষ্যকে নস্যাৎ করে সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলছেন নেতা-মন্ত্রীরা, প্রথম প্রথম মনে হত এ বুঝি সমালোচনা সহ্য করার অনিচ্ছা। স্তাবকেরা ক্ষমতার দ্বারা লালিত, ক্ষমতাবানও স্তাবকের আশ্রয়ে স্পর্ধাকে লালন করে। এমন রসঘন পার্টনারশিপের মধ্যে আলটপকা প্রশ্ন এসে পড়লে তা তো অসহ্য হবেই। কিন্তু ক্রমশ বোঝা গেল, অবুঝ ছেলেমানুষিপনা, কিংবা ক্ষমতামত্তের ঔদ্ধত্য, কোনওটাই এর পুরো ব্যাখ্যা নয়। এ হল অক্ষমতার প্রকাশ। যুক্তি-তর্ক দিয়ে নিজের অবস্থানকে প্রতিষ্ঠা করার কাজটা সহজ নয়। সরকারের কী লক্ষ্য, কোন পদ্ধতি, কেন তা বাছা হল, কোথায় তার সীমাবদ্ধতা, কেন সেটুকু মেনে নিতে হবে, এ নিয়ে আলোচনার মঞ্চে আসতে হলে তথ্য-পরিসংখ্যান চাই, তার ব্যবহারে দক্ষতা চাই, সর্বোপরি বিতর্কের কৌশল আয়ত্ত থাকা দরকার।
এর কোনওটা কি আছে তৃণমূল কংগ্রেসের? সবার জন্য রেশনের চাল, সব পড়ুয়ার জন্য সাইকেল, সব সরকারি হাসপাতালের বেড ফ্রি, সব ক্লাবকে লক্ষ লক্ষ টাকা, এমন কোনও সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে তৃণমূল সরকারও কোনও যুক্তি-তথ্য কখনও দেয়নি। প্রকল্পের লক্ষ্য কী, কোথা থেকে টাকার জোগান হবে, টাকা ঢেলেও লক্ষ্যপূরণ হবে কি না, কোনওটা নিয়েই বিতর্ক হয়নি। সরকারকে অন্যমত খণ্ডন করে নিজপক্ষ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাই করতে হয়নি। অনুমান করা যায়, সব প্রকল্পই সরকারের, অথবা মুখ্যমন্ত্রীর (না কি দুটো একই কথা?) কাছে স্বতঃসিদ্ধ বলে প্রতিভাত হয়েছে। যুক্তি-প্রমাণ দরকার নেই। ওই টাকা অন্যভাবে খরচ করলে লাভ বেশি হত কি না, বিবেচনারও দরকার নেই। সরকার প্রশ্নাতীত, সতত অভ্রান্ত। তা হলে সমালোচকরা ভ্রান্ত হবেই। সব সময়ে, সব প্রসঙ্গে। অতএব বিভ্রান্তির এমন ব্যাপ্তি, মোহ আবরণে এই হোলসেল আচ্ছন্নতা।
সম্প্রতি কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্নাকে প্রশ্ন করা গেল চাষিদের, বিশেষকরে ঠিকাচাষিদের আত্মহত্যা নিয়ে। মন্ত্রীর উত্তরে কোনও অস্পষ্টতা ছিল না। এ রাজ্যে ঠিকাচাষি নেই। ফড়ে নেই। মহাজন নেই। চাষিরা আত্মহত্যা করে না। এই পরাসত্যের রচনার ফলে এ রাজ্যের চাষি কোথায় দাঁড়াল, সে তো পরের কথা। কিন্তু মন্ত্রীর এতে ভারী সুবিধে হল। কারণ তাঁকে ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে না, কেন ফের ভূমিহীন চাষি ফিরে আসছে। কেন কিসান ক্রেডিট কার্ড পৌঁছয়নি সব চাষির হাতে। কেনই বা ফড়ের খপ্পর থেকে মুক্তি মেলেনি চাষির। এ রাজ্যের গ্রামে গেলে সাদা চোখে যা কিছু দেখা যায়, তার উপর আরোপিত হল তাঁর নিজস্ব সত্য— যেখানে সব সমস্যাই ভ্রান্ত।
এ ভাবেই শিল্পমন্ত্রী বলেন, প্রচুর বিনিয়োগ আসছে। শিল্পের অভূতপূর্ব বিকাশ হচ্ছে রাজ্যে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কলেজে ভর্তিতে, টেট-এর চাকরিতে কোনও দুর্নীতি নেই। পুলিশের কর্তারা বলেন, নির্বাচনে কোনও গোলমাল হয়নি। প্রশ্নের সম্ভাবনাকেই নস্যাৎ করা হচ্ছে তৃণমূলের রেডিমেড জবাব। যা কিছু প্রশ্ন তুলতে পারে, যেমন টিভি ক্যামেরা, সেগুলোকেও অগত্যা নস্যাৎ করতেই হয়। প্র্যাকটিকাল বেদান্তের স্বার্থে এটুকু তো মেনে নিতেই হবে।
তবে সাবেকি অধ্যাসের সংজ্ঞার সঙ্গে একটু তফাত রয়েছে এ রাজ্যের মায়াচ্ছন্নতার। বেদান্ত বলে, যা চেতন, তাকে অচেতন, জড়স্বভাব বলে মনে করাই অনাদিকালের মায়া। এ রাজ্যে হচ্ছে ঠিক উল্টো। সচেতন নাগরিককে চেতনাহীন, বোধবুদ্ধিহীন, জড়বস্তু করে তোলার যজ্ঞ চলছে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, তমোগুণীর কর্তব্যে-কর্মে অপ্রবৃত্তি হয়। উচ্ছিষ্টভোজন সে ভালবাসে। উল্টো বুদ্ধি হয়। আমাদেরও আজ সেই দশা। বিতর্ক-আলোচনা, গণতন্ত্রে নাগরিকের যা গোড়ার কর্তব্য, তাতে অনীহা। নেতাদের উচ্ছিষ্টে আসক্তি। যা নিপাট ফাসিজম, তাকে গণতন্ত্র বলে বোধ। সর্পে রজ্জুভ্রম।
অধ্যাস-মুক্তির কথাও অবশ্য বেদান্তে রয়েছে। বলা হচ্ছে, যে সোনার হার খুঁজে বেড়াচ্ছে, সে যখন হঠাৎ খেয়াল করে— আরে, হার তো আমার গলাতেই ছিল, তেমনই আত্মোপলব্ধির বোধ। গণতন্ত্রেও মানুষ একদিন খেয়াল করে, ক্ষমতা আছে তার ভিতরেই, নেতাদের হাতে নয়। গণতন্ত্রে সে উপলব্ধির সাধনাই রাজনীতি। কোনও রাজনৈতিক দল যদি সে রাজনীতি না করে, তবে নাগরিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংস্থা, মিডিয়ার উপর সে দায়টা একটু বেশি করে বর্তায়, এই যা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy