Advertisement
০৪ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

রাজধর্ম

ভোট মিটিয়াছে। হিংসা মিটে নাই। জয়পরাজয়ের ফয়সলা হইয়াছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির লড়াই স্পষ্টতই ভোটের ময়দানে শেষ হয় নাই। এখনও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত হইতে সন্ত্রাসের সংবাদ আসিতেছে। এখনও আগুন জ্বলিতেছে, এখনও রক্ত বহিতেছে। বর্তমানে হিংসাই এই রাজ্যের অভিজ্ঞান। সেই কারণেই, তামিলনাড়ুতে যখন এক দফায় গোটা রাজ্যের নির্বাচন করা যায়, পশ্চিমবঙ্গে সাত ধাপে করিতে হয়।

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৬ ০০:২২
Share: Save:

ভোট মিটিয়াছে। হিংসা মিটে নাই। জয়পরাজয়ের ফয়সলা হইয়াছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির লড়াই স্পষ্টতই ভোটের ময়দানে শেষ হয় নাই। এখনও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত হইতে সন্ত্রাসের সংবাদ আসিতেছে। এখনও আগুন জ্বলিতেছে, এখনও রক্ত বহিতেছে। বর্তমানে হিংসাই এই রাজ্যের অভিজ্ঞান। সেই কারণেই, তামিলনাড়ুতে যখন এক দফায় গোটা রাজ্যের নির্বাচন করা যায়, পশ্চিমবঙ্গে সাত ধাপে করিতে হয়। কিন্তু, কোথাও ঘুরিয়া দাঁড়াইতে হয়। বলিতে হয়, আর নহে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তেমনই এক মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়াইয়া আছেন। বিপুল জনাদেশ লইয়া তিনি দ্বিতীয় দফায় এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ লইবেন। প্রথম পর্বে যে ভুলগুলি ছিল, এই বার তিনি তাহা শুধরাইয়া লইবেন বলিয়াই আশা। দাবিও। প্রধানতম ভুলটি ছিল রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার রাশ সম্পূর্ণ ছাড়িয়া দেওয়া। সর্বাগ্রে সেই ভুলটি শুধরাইয়া লওয়াই বিধেয়। তাহার জন্য শপথগ্রহণ অবধি অপেক্ষার প্রয়োজন নাই। তিনি ইতিমধ্যেই মৌখিক বার্তা দিয়াছেন। কিন্তু কঠোরতা আবশ্যক। মুখ্যমন্ত্রী কঠোর ভাবে প্রশাসনকে বলুন, দলীয় রং বিচারের প্রয়োজন নাই। কেহ আইন ভাঙিলে, হিংসার আশ্রয় লইলে, আইন যেন তাহার নিজের পথে চলে। নিরপেক্ষ প্রশাসন রাজধর্মের প্রথম শর্ত। প্রথম পর্যায়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজধর্ম হইতে বিচ্যুত হইয়াছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে রাজধর্মে ফিরুন। দলের নহে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হইয়া উঠুন।

রাজ্যপালের পত্রটিকে এই প্রেক্ষিতে দেখাই বিধেয়। চিঠিটি তাঁহার অতিসক্রিয়তার নিদর্শন কি না, রাজ্যপাল প্রকৃত প্রস্তাবে একটি রাজনৈতিক অবস্থান লইতেছেন কি না, এই প্রশ্নগুলি হয়তো বর্তমান পরিস্থিতিতে অ-নিবার্য। কিন্তু তাঁহার চিঠিতে যে রাজ্যের নাগরিক সমাজের একটি গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত হইয়াছে, তাহাও অনস্বীকার্য। রাজ্যবাসী এই ঘটমান হিংসায় উদ্বিগ্ন, আতঙ্কিত। যাঁহারা এই হিংসার প্রত্যক্ষ শিকার, হিংসা শুধু তাঁহাদেরই ক্ষতি করিতেছে না— ক্ষতি গোটা রাজ্যের, তাহার ভাবমূর্তির। বিনিয়োগকারীদের নিকট পশ্চিমবঙ্গ এখন শুধু ‘চলিতেছে না, চলিবে না’-র পীঠস্থান নহে, তাহা এক সার্বিক ভাবে অশান্ত পরিসর। পুঁজি অশান্তিকে ডরায়। হিংসা বন্ধ না হইলে মুখ্যমন্ত্রী যতই চেষ্টা করুন, এই রাজ্যে বিনিয়োগ আসিবে না, উন্নয়নও অধরাই থাকিবে। কাজেই, তাঁহার দায়িত্ব বিপুল। অভিজ্ঞতা বলিতেছে, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার সিংহভাগ শাসক দলের বাহুবলীদের দ্বারাই সাধিত হয়। তাহাদের সংযত করাও মুখ্যমন্ত্রীরই দায়িত্ব। তাঁহার দলে তিনিই শেষ কথা। কাজেই, শান্তি ফিরাইয়া আনিবার কাজটি কঠিন হইলেও অসম্ভব নহে। চেষ্টা করা ভিন্ন মুখ্যমন্ত্রীর গত্যন্তর নাই।

দায়িত্ব বিরোধীদেরও। তাঁহারা বহু ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক হিংসার শিকার, কিন্তু হিংসা যাহাতে না ছড়ায়, তাহা নিশ্চিত করিতে তাঁহাদের ভূমিকাও খাটো নহে। বিজেপি নেতৃত্বের সাম্প্রতিক আচরণে এই কথাটি আরও সত্য হইয়া উঠিতেছে। এই নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তির মর্যাদা পাইয়াছে। কিন্তু, দলের নেতাদের একাংশের আচরণ এই মর্যাদার সহিত সঙ্গতিপূর্ণ নহে। সংশয়ের কারণ আছে, তাঁহারা যেন অশান্তির সন্ধানে রাজ্যময় ছুটিয়া বেড়াইতেছেন। কাহাকে চড় মারিয়া, কোথাও পুলিশের সহিত ধস্তাধস্তি করিয়া, আবার কোথাও প্রহৃত হইয়া তাঁহারা অশান্তির ধারাটি অব্যাহত রাখিতেছেন। নেতাদের দেখিয়া কর্মীরা উদ্বুদ্ধ হইলে তাঁহাদের দোষ দেওয়া মুশকিল হইবে। তাঁহারা বুঝুন, রাজনীতি মানে মল্লযুদ্ধ নহে। শাসক ও বিরোধী, উভয় পক্ষ সংযত হইলে, পুলিশ স্বধর্ম পালন করিলে হিংসা মিটিবে। মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব লউন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE