Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

লজ্জার উত্তরাধিকার

সত্য সুকঠিন। জানিলেও তাহাকে লুকাইয়া রাখিতে হয়। সুতরাং (মহাত্মা গাঁধী) জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পের দশ বত্সর পূর্তি লইয়া কলরবের শেষ নাই। রকমারি বিশেষজ্ঞ নানা ভাবে এই প্রকল্পের সার্থকতা বিচার করিতেছেন, কী ভাবে ইহাকে আরও সার্থক করিয়া তোলা যায় সেই বিষয়ে জ্ঞানের ফোয়ারা ছুটাইতেছেন, এই মহান কর্মসূচি রূপায়ণে সরকারি সদিচ্ছা এবং সক্ষমতার অভাব লইয়া ক্ষোভ দেখাইতেছেন।

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৫৯
Share: Save:

সত্য সুকঠিন। জানিলেও তাহাকে লুকাইয়া রাখিতে হয়। সুতরাং (মহাত্মা গাঁধী) জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পের দশ বত্সর পূর্তি লইয়া কলরবের শেষ নাই। রকমারি বিশেষজ্ঞ নানা ভাবে এই প্রকল্পের সার্থকতা বিচার করিতেছেন, কী ভাবে ইহাকে আরও সার্থক করিয়া তোলা যায় সেই বিষয়ে জ্ঞানের ফোয়ারা ছুটাইতেছেন, এই মহান কর্মসূচি রূপায়ণে সরকারি সদিচ্ছা এবং সক্ষমতার অভাব লইয়া ক্ষোভ দেখাইতেছেন। বিশেষত মোদী সরকার কেন এনআরইজিএ বা ‘মনরেগা’র প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী নহেন তাহা লইয়া বাম মনোভাবাপন্ন সমালোচকদের ক্রুদ্ধ বেদনার পেয়ালা ধূমায়িত। কংগ্রেসের রাজনীতিকরা স্বাভাবিক ভাবেই সেই নিন্দাবাদের প্রবল সমর্থক— ‘আমাদের এমন একটি জনমুখী উদ্যোগ বিজেপি আসিয়া নষ্ট করিয়া দিয়াছে’ বলিয়া তাঁহারা রাজনীতির জল ঘোলা করিয়া দুই-চারিটি মাছ ধরিয়া লইতে তত্পর। সর্বাপেক্ষা বিচিত্র অবস্থায় পড়িয়াছেন শাসকরা। প্রকল্পটি ইউপিএ উদ্ভাবিত, অথচ তাঁহারা ইহাকে ফেলিয়া দিতে পারেন না, জনপ্রিয়তা বড় বালাই। অতএব একটি কৌশল বাহির করিয়াছেন। তাঁহাদের বক্তব্য, পূর্ববর্তী সরকার এনআরইজিএ-র জন্ম দিয়াছে বটে, কিন্তু তাহা ভাল করিয়া রূপায়ণ করে নাই, সেই কাজটি করিতেছে বর্তমান সরকার। অর্থাত্, ইউপিএ জন্মদাতা হইতে পারে, কিন্তু ইহার প্রকৃত পালয়িতা এনডিএ। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জানাইয়াছেন, তাঁহারা এই প্রকল্পের দশ বত্সর পূর্তি উদ্‌যাপন করেন নাই, গত দেড় বছরে তাঁহাদের তত্ত্বাবধানে এই প্রকল্পের সফল রূপায়ণের উদ্‌যাপন করিয়াছেন! বিড়ম্বনা আর কাহাকে বলে।

অথচ সত্য কী, নরেন্দ্র মোদী তাহা জানেন। প্রায় এক বছর আগে সংসদে দাঁড়াইয়া কংগ্রেসের প্রতি তীব্র বিদ্রুপ সহকারে প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছিলেন, তিনি রাজনীতি বোঝেন, সুতরাং কখনওই মনরেগা বন্ধ করিবেন না, কারণ এই প্রকল্পটি কংগ্রেসের ষাট বছরের ব্যর্থতার প্রমাণ— আজও যে ভারতের দরিদ্রদের এমন প্রকল্পের উপর নির্ভর করিতে হয়, ইহা চরম লজ্জার বিষয়। কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যথেষ্ট এবং যথেষ্ট প্রসারিত হইলে দেশ জুড়িয়া কাজের জন্য হাহাকার থাকিত না, মাটি কাটিবার কাজ আবিষ্কার করিতেও হইত না। সরকারি বাজেটে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়া কাজের নিশ্চয়তা দিতে হয়, ইহা সাফল্যের অভিজ্ঞান নহে, ব্যর্থতার কলঙ্কস্বরূপ। ক্ষমতার প্রথম বর্ষে এই কথা বলিবার সাহস প্রধানমন্ত্রীর ছিল। ক্ষমতার বয়স বাড়িয়াছে, এখন তাঁহার গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী মনরেগার সফল রূপায়ণের সার্ধ-এক-বর্ষ পালন করিতেছেন!

এখানেই নরেন্দ্র মোদীর মৌলিক সমস্যা। তিনি পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়া ক্ষমতায় আসিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার স্বরাজ্যেরই এক ব্যক্তির একটি প্রসিদ্ধ উক্তি তিনি মনে রাখেন নাই অথবা হয়তো জানেনই না— মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী বলিয়াছিলেন, ‘তুমি যে পরিবর্তন দেখিতে চাও, নিজে সেই পরিবর্তন হও।’ মোদীর মস্তিষ্ক সেই পুরানো ছকেই বাঁধা, যাহা মনে করে, সরকার মা-বাপ, জনসাধারণের হাতে ‘রোটি কাপড়া অউর মকান’ নিজে হাতে করিয়া তুলিয়া দিতে পারিলেই সরকারের জন্ম ও কর্ম সার্থক। এই মস্তিষ্ক কর্মসংস্থানকেও একটি সরকারি পুণ্যকর্ম হিসাবেই দেখিয়া থাকে। যদি বা ঈষৎ অন্য রকম ভাবিবার কথা কিছু কাল তাহার মনে হয়ও, অচিরেই ভারতীয় রাজনীতির সর্বগ্রাসী আবর্তে সেই ভিন্ন-চিন্তা ডুবিয়া যায়। মনরেগা গৌরবের নহে, লজ্জার কারণ। এই লজ্জার উত্তরাধিকার বহন করিয়া চলিবেন বলিয়াই কি নরেন্দ্র মোদী মনমোহন সিংহের ছাড়িয়া যাওয়া আসনে বসিয়াছিলেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE