কলিকাতাকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আদর করিয়া বলিতেন ‘দ্য সেকেন্ড সিটি অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’। তাঁহারা কলিকাতাকে লন্ডন বলেন নাই। বলিতে চাহেন নাই। লন্ডন লন্ডনই। তবে এই দ্বিতীয় নগরীর বহু কিছু তাঁহারা লন্ডনের অনুসরণে গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। কলিকাতা সেই সকল চিহ্ন এখনও কিছু কিছু বহন করিতেছে। সাহেবদের কলিকাতা মূলত কেন্দ্রীয় কলিকাতা। উত্তরে নেটিভ পাড়া বা ব্ল্যাক টাউন। সেই টাউনের জলনিকাশি ব্যবস্থা খারাপ, রেতে মশা দিনে মাছি। মৃতদেহ পড়িয়া থাকে। নালি খোলা। রোগ শোক অবিরত। নগরের পরিবেশে শিক্ষার অভাব। বিবেকানন্দ তাঁহার ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থে এই ব্ল্যাক টাউনের দুর্দশার কথা লিখিয়াছিলেন। তস্য ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের রচনায় তাহার বিবরণ আরও দীর্ঘ। শকুনের ওড়াউড়ি, মৃত্যুর মিছিল। ঔপনিবেশিক সাহেবপাড়ার বাড়ি-ঘর অবশ্য অন্যপ্রকার। তখন তাহার নাম হোয়াইট টাউন। বিস্তীর্ণ নহে সেই সাহেবপাড়া। বর্তমান বিবাদী বাগ, ধর্মতলা, পার্ক স্ট্রিট অঞ্চল সাহেবপাড়ার স্মৃতিবাহী। সাহেবি আমলে কলিকাতা দক্ষিণের অস্তিত্ব অনেক দিন অবধি নগরী হিসাবে ছিল না। দক্ষিণের কালীঘাট পীঠস্থান। মঙ্গলকাব্যে তাহার উল্লেখ আছে। তবে সে তো নগরী নহে, জঙ্গলাকীর্ণ। তাহার মাঝে দেবমন্দির।
সাম্রাজ্য অতীত। শৈশবস্মৃতি দুর্মর। অতএব, কলিকাতা লন্ডন হইবে, এই বাসনা ফিরিয়া আসে। কলিকাতা দক্ষিণ গড়িয়া উঠিয়াছে, পূর্বে জমিয়া উঠিয়াছে আরেক রকম কলিকাতা। তাহাতে কী? কলিকাতাকে লন্ডন না করিলে কী চলে। সাহেবরা তাঁহাদের সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগরীকে ভালবাসিতেন, কিন্তু লন্ডন করিতে চাহেন নাই। আমরা করিব। কে বলে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় না? হয়। উন্নততর ভাবে হয়। কেবল কেন্দ্রীয় বা মধ্য কলিকাতা নহে, আমরা এ বার পুরা কলিকাতাকে লন্ডন করিব। কালীঘাটে জঙ্গল নাই, দেবী আছেন। সেই দেবীর মহিমাতে কী না হয়! বোধকরি সামূহিক নির্জ্ঞানে এই বাসনা ঘাই মারিতেছিল। এখন দৈববাণী রূপে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হইতেছে। কিন্তু যাহা করিব তাহাকে তো আগে দেখিতে হইবে। না দেখিলে, মানসপটে মুদ্রিত না করিলে সেই শিল্পিত নবনির্মাণ কেমন করিয়া সম্ভব! সুতরাং লন্ডন যাত্রা সম্পন্ন হইল।
কিন্তু সেখানে গিয়া কী দেখিলেন বঙ্গবাসীর প্রতিনিধিরা। দেখিলেন সেখানেও আবর্জনা। দেখিয়া তাঁহাদের বুঝি মনে হইল: আহা কী দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না। সত্যই তো, ভাগীরথী তীরে কলিকাতাতেও আবর্জনা, টেমস তীরে লন্ডনেও আবর্জনা। তাহা হইলে আর কলিকাতার লন্ডন হইবার বাকি কী রহিল! তাহার উপর আর একটি বোধও প্রকট হইল। ইংরাজি লইয়া নাকউঁচুপনা গিয়াছে। সাহেবদের যেমন তেমন ইংরাজি শ্রবণ করানো সম্ভব। তাঁহারা সজ্ঞানে তাহা শ্রবণ করেন। কেবল শ্রবণই করেন না, উপভোগও করেন। বঙ্গজ কলিকাত্তাইয়া বাচনের এ যেন বিশ্বজয়। এই সংসারে অবশ্য আর যাহা কিছু থাকুক না কেন, নিন্দকের অভাব নাই। কথামৃত স্মরণীয়। পরমহংসদেব বলিয়াছিলেন, বিশেষ পক্ষী যত উচ্চেই উঠুক না কেন, তাহার দৃষ্টি সেই আবর্জনার দিকেই থাকে। লন্ডনে গিয়াও উন্নততর সভ্যতার রকমসকম না দেখিয়া আমরা নাকি কেবল আবর্জনাই দেখিতেছি। নিন্দকের কথায় কান দিতে নাই। টেমস নদীর তীরে জঞ্জাল আবিষ্কারেই নিশ্চিত প্রমাণ হইল, লন্ডন কলিকাতা হইয়াছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy