Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

লি কুয়ান ইউ তাঁর আদর্শ হতে পারেন না

নরেন্দ্র মোদী যা-ই বলুন না কেন, সিঙ্গাপুরের সদ্যপ্রয়াত রাষ্ট্রনেতার পথে হাঁটা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। কোথাও ভারতীয় গণতন্ত্র তাঁকে বাধা দেবে, আর কোথাও তাঁর রাজনীতি।সিঙ্গাপুরের সদ্যপ্রয়াত রাষ্ট্রনায়ক লি কুয়ান ইউ-এর উদ্দেশে শোকপ্রস্তাবে নরেন্দ্র মোদী লিখলেন, তিনি আমার কাছে অনুপ্রেরণা। কথাটা সত্যি কি না, সে তর্কে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু, যতই ভারতের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকুক সিঙ্গাপুরের প্রয়াত রাষ্ট্রনেতার সম্মানে, যতই প্রধানমন্ত্রী লিখুন, “আমি এই কর্মযোগীকে কুর্নিশ জানাই”, তাঁর পক্ষে লি কুয়ান ইউ-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়া কঠিন।

কেবলই ছবি। সিঙ্গাপুরে লি কুয়ান ইউ-এর স্মরণে মন্তব্য লিখছেন নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।

কেবলই ছবি। সিঙ্গাপুরে লি কুয়ান ইউ-এর স্মরণে মন্তব্য লিখছেন নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

সিঙ্গাপুরের সদ্যপ্রয়াত রাষ্ট্রনায়ক লি কুয়ান ইউ-এর উদ্দেশে শোকপ্রস্তাবে নরেন্দ্র মোদী লিখলেন, তিনি আমার কাছে অনুপ্রেরণা। কথাটা সত্যি কি না, সে তর্কে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু, যতই ভারতের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকুক সিঙ্গাপুরের প্রয়াত রাষ্ট্রনেতার সম্মানে, যতই প্রধানমন্ত্রী লিখুন, “আমি এই কর্মযোগীকে কুর্নিশ জানাই”, তাঁর পক্ষে লি কুয়ান ইউ-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়া কঠিন।

নরেন্দ্র মোদীদের কাছে অবশ্য লি কুয়ান ইউ-এর আকর্ষণও অমোঘ। সিঙ্গাপুরের এই পিতৃপুরুষ আর বজ্রমুষ্টিতে শাসন যেন প্রায় সমার্থক। নিজে যাকে উন্নয়ন বলে মনে করেছেন, সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে কোনও বাধার কাছেই কখনও মাথা নোয়াননি লি। তিনি উন্নয়নের যে সংজ্ঞায় বিশ্বাসী, সেটাই একমাত্র সংজ্ঞা কি না, সংজ্ঞাটি আদৌ সবার কথা মনে রাখে কি না, এই প্রশ্নগুলোকে পাত্তাও দেননি। যখন দেশে কমিউনিস্টদের বাড়বাড়ন্ত হচ্ছিল, তখন তাদের বিনা বিচারে, এমনকী বিনা পরোয়ানায় দীর্ঘ দিন জেলে পুরে রাখতে দ্বিধা করেননি লি। পরেও, রাজনৈতিক বিরোধীদের নাকাল করার বিচিত্র সব ফিকির তাঁর মগজ থেকে বেরিয়েছে। বিরোধীদের মানহানির মামলায় জড়িয়ে একেবারে সর্বস্বান্ত করে ফেলার কৌশলটার গায়ে তাঁর ট্রেডমার্ক অনপনেয়। লি কুয়ান ইউ বলতেন, যদি আমাকে কেউ ভয়ই না পেল, তা হলে আমার অস্তিত্বটাই অর্থহীন হয়ে পড়বে।

এই দোর্দণ্ডপ্রতাপের ফল গণতন্ত্রের পক্ষে ইতিবাচক হয়নি। এমনিতে দুনিয়ায় যত তালিকা তৈরি হয়, সিঙ্গাপুরের স্থান তার সবেরই প্রথম সারিতে। ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে সিঙ্গাপুর এক নম্বর। গ্লোবাল করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স অনুযায়ী সিঙ্গাপুর বিশ্বের সপ্তম দুর্নীতিহীন দেশ। এ দিকে, গ্লোবাল ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্সে বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুর একেবারে ৭৫ নম্বরে। কাকে পাওয়ার জন্য লি কুয়ান ইউ কাকে ছেড়েছেন, সংশয়ের অবকাশ নেই।

গণতন্ত্রকে এ ভাবে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় করার স্বপ্ন বহু রাষ্ট্রনায়কই দেখে থাকেন। নরেন্দ্র মোদীই কি কম খুশি হতেন, যদি ঘ্যানঘ্যানে অসরকারি সংস্থা, কিছু নাছোড় পরিবেশকর্মী, মানবাধিকার নিয়ে অদম্য আন্দোলনকারী বা মানবোন্নয়নের খড়কুটো ছাড়তে রাজি না হওয়া ঝোলাওয়ালাদের এমন সপাট কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলা যেত? কিন্তু, তাঁকে মেরে রেখেছে ভারত। এ এমন বিচিত্র দেশ, যা নরেন্দ্র মোদীর ঝুলি ভরে ভোট দিতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্র নিয়ে খুব বেশি ছেড়খানি সহ্য করবে না। ইন্দিরা গাঁধী বহু মূ্ল্যে এই সারসত্যটি শিখেছিলেন। নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী জানেন, ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতির ভিতরে যে ইচ্ছেই থাক, গণতন্ত্রের আব্রুটুকু রক্ষা না করে তাঁর উপায় নেই। অতএব, তিনি বড় জোর অসরকারি সংস্থার নামের তালিকা তৈরি করে নজরদারি করতে পারেন, প্রিয়া পিল্লাইকে বিমানের আসন থেকে নামিয়ে আনতে পারেন, অথবা তিস্তা শেতলবাদের পিছনে পুলিশ লেলিয়ে দিতে পারেন। এর বেশি এগোনোর সাহস তাঁর হবে না।

সাহসে কুলোবে না কল্যাণ-অর্থনীতিকে বাতিল ঘোষণা করাও। লি কুয়ান ইউ বলতেন, কোনও পরিষেবাই বিনা মূল্যে দেওয়ায় তিনি বিশ্বাস করেন না। শিক্ষা থেকে চিকিৎসা, সব ক্ষেত্রেই নীতি, ফেলো কড়ি, মাখো তেল। এই কথাটিও নরেন্দ্র মোদীর বিলক্ষণ পছন্দ হওয়ার মতো। মুশকিল হল, যে দেশে আশি শতাংশ ভোট এখনও গরিব মানুষের হাতে, সেখানে বাজারের এতখানি জয়গান নির্বাচনী ধর্মে সইবে না। অতএব, এই ক্ষেত্রেও মোদীর পক্ষে লি কুয়ান ইউকে আদর্শ মেনে চলা সম্ভব নয়। তাঁকে খিড়কির দরজার ভরসাতেই থাকতে হবে। সেই দরজা দিয়ে তিনি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ব্যয় কমিয়ে দেবেন, গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার টাকা আটকে রেখে প্রকল্পটিকে রক্তশূন্য করে দেবেন। কিন্তু, মুখে বলতে হবে, একশো দিনের কাজের প্রকল্প তাঁর হৃদয়ের খুব কাছাকাছি থাকে। এই কথাটি না বললে ভোটের দেবতা রুষ্ট হবেন।

কিন্তু, শুধু গণতন্ত্রের চরাতেই নরেন্দ্র মোদীর লি কুয়ান ইউ হওয়া ভেস্তে গেল, এমন দাবি করলে অন্যায় হবে। গুগল ম্যাপে অনেকখানি জুম করলে তবে দেখা যাবে, এমন একটা ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রকে, তার প্রাকৃতিক সম্পদের শূন্য ভাঁড়ারসহ, কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্বের প্রথম সারির দেশ করে তোলা খুব কম কৃতিত্বের কথা নয়। সেটা শুধু মাথাপিছু জিডিপি-র হিসেবে নয়, মানব উন্নয়ন সূচকের অঙ্কেও। সেই তালিকায় সিঙ্গাপুর বিশ্বের প্রথম দশটা দেশের অন্যতম। কল্যাণরাষ্ট্রের খয়রাতির মাধ্যমে নয়, সিঙ্গাপুর এই উচ্চতায় পৌঁছেছে শ্রেষ্ঠ নাগরিক পরিষেবার ব্যবস্থা করে। এবং, তার পিছনে আছে অর্থনীতির যুক্তি। নিজের জোর ঠিক কোথায়, সেটা চিনে নিয়ে তাকেই আর্থিক উন্নতির পাখির চোখ করতে পারার মধ্যে এক বিরল দূরদর্শিতা আছে। অবশ্য, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস-এর সেরা ছাত্রের কাছে যে দূরদর্শিতা প্রত্যাশিত, আরএসএস-এর পাঠশালায় দুনিয়াদারির বোধ তৈরি করা এক স্বয়ংসেবকের কাছে তা আশা করা মুশকিল।

রাজনীতির ময়দানেও অবশ্য মোদী লি কুয়ান ইউকে অনুসরণ করার চেষ্টা করবেন না। লি জাতিগত পরিচয়ে চিনা। সিঙ্গাপুরের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষই তাই। জনসংখ্যার অবশিষ্টাংশ মালয়েশিয়া থেকে আসা মুসলমান এবং ভারতীয়, মূলত হিন্দু। জনসংখ্যার এই ছবির একটা নিজস্ব টান থাকাই স্বাভাবিক ছিল, চিনা খণ্ড জাতীয়তাবাদের দিকে। স্বাভাবিক ভাবেই লি কুয়ান ইউ এই চিনা ভোটব্যাঙ্ককে টানতে চাইতে পারতেন নিজের দিকে। তার জন্য বেশি কিছু প্রয়োজন হত না। চিনা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হত, এবং সংখ্যালঘুদের একটু কড়কে দিলেই চলত। কিন্তু, তিনি সম্পূর্ণ উল্টো পথে হাঁটলেন। ইংরেজিকে দেশের সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দিলেন। প্রত্যেক চারটে থেকে ছটা নির্বাচনী কেন্দ্রকে এক সঙ্গে জুড়ে দিয়ে তৈরি করলেন গ্রুপ রিপ্রেজেন্টেশন কনস্টিটুয়েন্সি। যেখানে, নির্দিষ্ট সংখ্যক সংখ্যালঘু প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতেই হবে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে, যাতে দেশের পার্লামেন্টে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বে ঘাটতি না পড়ে কখনও। সরকারি আবাসনে সংখ্যালঘুদের জন্য নির্দিষ্ট কোটা তৈরি করে দিলেন, যাতে কখনও তাঁরা শহরের মূল জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়েন। বস্তুত, তাঁর রাজনৈতিক জীবনে একটি অভিযোগেরই মুখের ওপর জবাব দিতে পারেননি লি কুয়ান ইউ— যত বার অভিযোগ উঠেছে যে তিনি চিনাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে সংখ্যালঘুদের দেখেছেন, তত বারই মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু, এই নীতি থেকে সরে আসেননি।

মোদীর ঐতিহাসিক লোকসভা বিজয়ের বছরে তাঁর দল গোটা দেশ জুড়ে মাত্র সাত জন মুসলমান প্রার্থী দিতে পেরেছিল। তাঁদের মধ্যে এক জনও জেতেননি। অর্থাৎ, তাঁর আমলে তাঁর সংসদীয় দলে দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই। লি কুয়ান ইউ-এর মডেলে এটা অসম্ভব হত। যেমন অসম্ভব হত হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালানোর পুরনো খেলাকে ফের নতুন চেহারায় ফিরিয়ে আনা, গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা, ঘর ওয়াপসি অথবা স্কুলে সূর্যবন্দনা। অসম্ভব হত যোগী আদিত্যনাথ, সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি, সাক্ষী মহারাজ অথবা গিরিরাজ সিংহদের সাংসদ পদ বজায় রাখা। লি কুয়ান ইউ রাজনীতির প্রাঙ্গণে ধর্মের অনুপ্রবেশের ঘোর বিরোধী ছিলেন। একেবারে আইন করে বন্ধ করে দিয়েছিলেন ধর্মীয় রাজনীতি। ফলে, মোদী যদি সত্যিই লি কুয়ান ইউকে তাঁর অনুপ্রেরণা হিসেবে মেনে নেন, তাঁর দলের অনেক সাংসদই আর সংসদে নয়, জেলে থাকতেন।

এই পথে হাঁটতে চাইলে ভারতীয় গণতন্ত্র তাঁর বাধা হয়ে দাঁড়াত না। কিন্তু, নরেন্দ্র মোদী জানেন, এটা তাঁর পথ নয়। তিনি বজ্রমুষ্টির শাসক লি কুয়ান ইউ-কে পারলে অনুসরণ করতেন। কিন্তু, সে-ও হওয়ার নয়। অতএব, তাঁর স্মরণে নরেন্দ্র মোদী যা-ই লিখে আসুন না কেন, লি কুয়ান ইউ হওয়া তাঁর জন্য নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE