Advertisement
১১ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

শিরোপা ও ব্যর্থতা

তা হারা ভয় পাইয়াছিল। পাইবারই কথা। আসন্ন মৃত্যুকে তাহারা প্রত্যক্ষ করিয়াছে। নিতান্ত স্বল্প বয়সে। ইহারা সকলেই আট হইতে সতেরো।

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

তা হারা ভয় পাইয়াছিল। পাইবারই কথা। আসন্ন মৃত্যুকে তাহারা প্রত্যক্ষ করিয়াছে। নিতান্ত স্বল্প বয়সে। ইহারা সকলেই আট হইতে সতেরো। কিন্তু কোনও ভয়, এমনকী মৃত্যুভয়ও তাহাদের দমাইতে পারে নাই। চরম বিপদেও তাহারা অসাধারণ সাহস ও বুদ্ধির পরিচয় দিয়াছে এবং শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে অসম যুদ্ধে জয়ীও হইয়াছে। কেহ নারীপাচারকারীদের ধরিবার জন্য পুলিশের পাতা ফাঁদে টোপ হইয়াছে, কেহ চিতাবাঘের হাত হইতে ভাইকে বাঁচাইয়াছে। কেহ নিজে বাঁচিতে পারে নাই, কিন্তু অন্যের জীবন বাঁচাইয়াছে। তাহারা বীর। এই পঁচিশ জন বীরপুরুষকে ‘জাতীয় সাহসিকতার সম্মান’ প্রদানের সিদ্ধান্ত লইয়াছে কেন্দ্রীয় সরকার। উদ্দেশ্য, ব্যক্তিগত সাহসিকতার এমন নজির যাহাতে অন্যদেরও অনুপ্রেরণা হয়।

প্রশংসনীয় উদ্যোগ। শিশু-কিশোররা দেশের ভবিষ্যৎ। সুতরাং, দেশকে সুরক্ষিত করিতে হইলে তাহাদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত লইবার ক্ষমতা, অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়াইবার মানসিকতাকে কুর্নিশ জানাইতে হইবে বইকী! স্বল্প বয়স বলিয়াই হয়তো ঝুঁকি লইবার এই প্রবণতা তুলনায় বেশি। তাহাদের বুদ্ধি তো ‘পরিণত’ নহে যে, বিপদ আসন্ন দেখিলে নিজ লাভক্ষতির হিসাব করিতে বসিবে। সুতরাং, তাহারা জীবন বিপন্ন করিয়াছে। যেমনটা বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন দেশে করিয়া আসিয়াছে। ইতিহাস সাক্ষী— নানা সময়ে উদ্ভূত বৈপ্লবিক চিন্তাধারার মূল সূত্রটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অল্পবয়সিদের হাতে ছিল। প্রতি ক্ষেত্রেই সাফল্য আসে নাই, কর্মপদ্ধতিও বহুল সমালোচিত। কিন্তু মানিতেই হইবে, সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি, ধর্ম-সহ নানা ক্ষেত্রের বদ্ধ, জীর্ণ কাঠামোয় অক্সিজেনটুকু তাহারা আনিয়াছে। সুতরাং, প্রাপ্তবয়স্কদের অমানবিকতার অসংখ্য নজিরে কিছু অপ্রাপ্তবয়স্ক, অথচ মানবিক ভাবনা স্বাগত। পরিণত বুদ্ধির হিসাব-খাতার বাহিরেও যে এক মানবিক পৃথিবী আছে, বীরত্বের দৃষ্টান্তগুলি তাহার প্রমাণ দেয়। সেই কারণেই এরূপ দৃষ্টান্ত আরও বেশি তুলিয়া ধরা প্রয়োজন। এই মহান দায়িত্বটি সরকার যদি ফি বছর পালন করিয়া চলে, তাহাতে আপত্তির কিছু নাই।

তবে একটি প্রশ্ন আছে। সরকারকে ব্যক্তিগত বীরত্বের এমন জয়জয়কার করিতে হয় কেন? অংশত, নিজ ব্যর্থতা ঢাকিবার জন্য নয় কি? অপ্রাপ্তবয়স্করা অনেকেই যে ক্ষেত্রগুলিতে বীরত্বের প্রমাণ দিয়া সম্মানিত হইয়াছে, তাহার অনেকগুলিতেই সরকার চূড়ান্ত ব্যর্থ। এই সম্মান এক অর্থে সেই ব্যর্থতার প্রমাণপত্রও বটে। দুইটি মেয়ে নারীপাচারকারীদের ধরিতে সাহায্য করিয়াছে। অর্থাৎ, পাচারচক্র এখনও দেশে সক্রিয়। শুধুমাত্র সক্রিয় বলিলে সত্যের অপলাপ হইবে। পুলিশ-প্রশাসনের কার্যত নাকের ডগায় বসিয়া পাচারকারীরা ব্যবসা চালাইতেছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কাজে ঘাটতি যথেষ্ট, সঙ্গে পরিকল্পনাহীন বসতি বিস্তার। পরিণাম, লোকালয়ে বন্যপ্রাণীর হানা। পুরস্কারপ্রাপকদের তালিকাভুক্ত ছেলেটিকে তাই জীবনের ঝুঁকি লইয়া ভাইকে বাঁচাইতে হয়। আর এক প্রতিবাদিনীর কাহিনিও তাৎপর্যপূর্ণ। সরকার যাহা পারে নাই, সেই নাবালিকা-বিবাহ রোখা, এবং নাবালিকাদের অধিকার-সচেতন করিবার দায়িত্বটি ওই প্রতিবাদিনীকেই তুলিয়া লইতে হইয়াছে। নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেশ‌্ট-এর কথা ধার করিয়া বলা যায়, সত্যই এ দেশ দুর্ভাগা, কারণ আজও তাহাকে ‘হিরো’র অনুসন্ধান চালাইতে হয়। এমন ‘বীরত্ব’-এর পুরস্কারের ব্যবস্থা যাহাতে না করিতে হয়, তাহা ভাবাই সরকারের কাজ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE