Advertisement
১১ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

শাস্তির যুক্তি

অপরাধ এবং শাস্তির ভারসাম্যটি ঠিক কেমন হওয়া উচিত, বিচারশাস্ত্রে ইহা নিশ্চয় চিরকাল একটি গুরুতর প্রশ্ন। তবে সম্প্রতি প্রশ্নটি ক্রমেই জটিলতর হইয়া উঠিতেছে। ব্রিটিশ দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম দর্শিত আদর্শে কঠোর শাস্তির মাধ্যমে অপরাধীকে অপরাধ হইতে নিবৃত্ত করার পদ্ধতির বাহিরে অন্যান্য পথের সন্ধান চলিতেছে।

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৬
Share: Save:

অপরাধ এবং শাস্তির ভারসাম্যটি ঠিক কেমন হওয়া উচিত, বিচারশাস্ত্রে ইহা নিশ্চয় চিরকাল একটি গুরুতর প্রশ্ন। তবে সম্প্রতি প্রশ্নটি ক্রমেই জটিলতর হইয়া উঠিতেছে। ব্রিটিশ দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম দর্শিত আদর্শে কঠোর শাস্তির মাধ্যমে অপরাধীকে অপরাধ হইতে নিবৃত্ত করার পদ্ধতির বাহিরে অন্যান্য পথের সন্ধান চলিতেছে। এই সন্ধানের সূত্রে অপরাধ কি অনেক সময় তাহার গুরুত্ব হারাইতে বসিয়াছে? শাস্তি ছাড়া অন্য কোনও ভাবে অপরাধীর দায়িত্বের সমাধান কি অপরাধ-আক্রান্তের প্রতিই পরোক্ষ অবিচার হইয়া দাঁড়াইতেছে? এই সব সংশয় আবার নূতন করিয়া প্রাসঙ্গিক হইয়া উঠে ভারতের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের একটি সাম্প্রতিক রায়ের প্রেক্ষিতে। সুপ্রিম কোর্টের অভিমত, ধর্ষণ কিংবা খুনের ক্ষেত্রে অপরাধী এবং অপরাধাক্রান্ত পক্ষের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া কোনও সমাধান হইতে পারে না। বোঝাপড়ার মাধ্যমে অপরাধাক্রান্ত পক্ষ বা ব্যক্তির যেমন গতিই হউক না কেন, বৃহত্তর সমাজের তাহাতে বিপুল ক্ষতির সম্ভাবনা। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় কেবল গুরুতর নহে, প্রবল ভাবে সময়োচিতও বটে। একের পর এক মর্মান্তিক অপরাধের ভারে জর্জরিত ভারতীয় সমাজের কাছে আদালতের এই বার্তা পৌঁছনো খুবই জরুরি। জরুরি কেবল ভাবী অপরাধীদের জন্য নহে, ভাবী আক্রান্তদের জন্যও। কোন ধরনের অধিকার বিষয়ে কতখানি সতর্কতা প্রয়োজনীয়, এই রায় সেই দিকে নির্দেশ করে।

একটি কথা প্রথমেই স্পষ্ট হওয়া ভাল। ধর্ষণ ও খুন একই গোত্রের অপরাধ নয়। যাঁহারা ধর্ষণকে নারীচরিত্রের ‘হনন’ বলিয়া বর্ণনা করেন, তাঁহাদের জানা দরকার ধর্ষণ একটি গুরুতর শারীরিক নিগ্রহ, অমার্জনীয় নির্যাতন, কিন্তু ‘হনন’-এর চূড়ান্ততা তাহাতে আরোপ করা যায় না। তবে অন্য এক দিক হইতে অবশ্য দুই অপরাধের মিল আছে। দেহ বা শরীরের উপর যে ব্যক্তি-অধিকার, সেই মৌলিকতম অধিকারটি দুই ক্ষেত্রেই প্রবল ভাবে আক্রান্ত হয়। সমাজকে ‘সভ্য’ হইতে হইলে এই মৌলিক অধিকারটি নিশ্চিত করিতেই হইবে, গত্যন্তর নাই। সেই যুক্তিতেই বিচারপতিরা এই দুই অপরাধের একত্র আলোচনা করিয়াছেন। সেই যুক্তিতেই ইহাদের ক্ষেত্রে শাস্তি ভিন্ন অন্য বিচারের কথা ভাবিতে রাজি হন নাই। এক বার এমন অপরাধ সংঘটিত করিলে অপরাধীকে শাস্তি-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া যাইতেই হইবে, নতুবা অপরাধের অনন্য ও প্রাথমিক গুরুত্বটি অনুধাবন করা মুশকিল।

বোঝাপড়া-মূলক সমাধানের ক্ষেত্রে কিন্তু বিচারের সংবেদনশীলতার সঙ্গে অসংবেদনশীলতাও প্রকাশ পায়। ধরা যাক, ধর্ষণের ক্ষেত্রে যখন অত্যাচারিতার সহিত নিগ্রহকারীর বিবাহ নামক বোঝাপড়া হয়, তখন তাহার মধ্যে নিগ্রহকারীর প্রতি সংবেদনশীলতার সঙ্গে নিগৃহীতার প্রতি অসংবেদনশীলতাও থাকে। যে যৌথ জীবনের আরম্ভেই সহিংস নির্যাতন, তাহার গতি ও প্রকৃতি অনুমান করা কঠিন নয়। এমনিতেই যে দেশে বিবাহোত্তর নারী-নির্যাতনের হার এত ভয়াবহ, সেখানে এমন বোঝাপড়া কোনও সামাজিক স্থিতির লক্ষণ হইতে পারে না। এ সকল ক্ষেত্রে সমাজের অশান্তি কমাইতে ব্যক্তির অধিকারটিই পদদলিত হয়। অপরাধের সমাধান যে আসলে একটি মাত্র কার্য-ভিত্তিক নয়, বরং একটি কার্যের ভিত্তিতে মানুষের জীবনে যে বিরাট পরিবর্তন আসে, তাহার সবটুকুকে লইয়াই সমাধানের প্রাসঙ্গিকতা, বিচারপ্রক্রিয়া এই গোড়ার কথাটি ভুলিতে পারে না। আক্রান্ত পক্ষকেও জানিতে হইবে যে তাঁহাদের যে অধিকার দলিত হইয়াছে, তাহা কেবল ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা আর্থিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে পূরণযোগ্য নহে। আক্রান্ত পক্ষের ইহা জানা অবশ্যকর্তব্য, কেননা তাঁহাদের দাবি যথাযথ ভাবে উঠিয়া আসিলে তবেই সমাজের আত্মসংশোধনের জায়গাটি দৃঢ় হইবার সম্ভাবনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE