তদন্ত। মাদ্রাসায় এনআইএ’র সন্ধানীরা। ডোমকল, মুর্শিদাবাদ, অক্টোবর ২০১৪।
বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডের পর মনে হচ্ছে দীর্ঘ শীতঘুমে ছিলাম সবাই। ঘুম ভেঙে হতবাক হয়ে চেয়ে আছি কূলকিনারাহীন অন্ধকারের দিকে। এত হিংসা, নির্মমতা তাও পশ্চিমবঙ্গে! ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, ভয় হচ্ছে, আমরা ঠিক কতখানি নিরাপদ।
পরিস্থিতি এমন ছিল না। আশির দশকের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ধর্মের চেয়ে মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জীবনের প্রতিষ্ঠা। মুসলিম গ্রামগুলিতে শিক্ষার হার ছিল খুবই অল্প। তবু কৃষিকাজ করে, দূর রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করে গরিব মুসলমান পায়ের নীচে মাটি খুঁজতে শুরু করে। নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধ থেকে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। তত্কালীন শাসক দলের কাছে ভোটই ছিল মুখ্য বিষয়। দেখে না-দেখার ভান করা। প্রশাসন ও সমাজকে ঠুঁটো বানিয়ে লোকাল কমিটি-ভিত্তিক এক সমাজ বামপন্থীরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অলিতে গলিতে খারিজি মাদ্রাসার গজিয়ে ওঠা তখন থেকেই। দেখতে দেখতে মেয়েদের বোরখার প্রচলন শুরু হল। পার্থিব জগত্ নাকি মূল্যহীন। সব সুখ পরকালে। পরকালে জান্নাত তথা স্বর্গ পাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য। পৃথিবী তুচ্ছ একটি স্থান। বিজ্ঞান চর্চা অন্যায়। গানবাজনার চর্চা অধর্ম। এমন সব আজগুবি, যুক্তিহীন, মনগড়া কথাবার্তার প্রচার শুরু করে মৌলবাদীরা। সর্বত্র এমন হয়েছে বলছি না, তবু ডালপালা মেলতে থাকে মৌলবাদ। একটি একটি করে দিন অতিক্রান্ত হতে থাকে। দু’হাজার পাঁচ-ছয় থেকে সমাজে আরও গভীর ভাবে মৌলবাদের শিকড় প্রোথিত হয়।
সব মাদ্রাসা খারাপ, এমন মন্তব্য কেউ করছেন না। বরং অনেক মাদ্রাসা সমাজসেবার কাজ করে। তবু লক্ষ করা গেছে, গ্রামীণ মুসলমান সমাজের দানের প্রায় পুরো অর্থটিই চলে যায় ধর্মীয় পরিসরে আর মাদ্রাসার গহ্বরে। প্রচুর অর্থ সংগৃহীত হয় গ্রামে গ্রামে, মৌলবি সাহেব আবেগময় বক্তৃতা দিয়ে অর্থ তোলেন। তা ব্যয় করা হয় ধর্মীয় কাজে। মৌলবিদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থাও ওখান থেকেই হয়। আর এই অন্ধকারের পিছনে পড়ে থেকেছে আস্ত একটা গ্রাম। যেখানে ওই সংগৃহীত অর্থে দিব্যি কয়েকজন গরিব ছাত্রের পড়াশোনার দায়িত্ব নেওয়া যেত। বিজ্ঞানমঞ্চ নির্মাণ করে তরুণ প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা যেত। আরও একটি বিষয় লক্ষ করা গেছে, গ্রামের দিকে পুরনো দিনে কবিগান, নাটক, যাত্রার আসর বসত। অনেক গ্রামেই মৌলবাদীরা চোখ রাঙিয়ে এ-সব বন্ধ করে দিয়েছে। এখন অধিকাংশ গ্রামেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন পালিত হয় না। সাতের দশক পর্যন্ত নজরুল যে-ভাবে সমাদৃত হতেন, আলাদা করে তাঁর কবিতা গুনগুন করত যুব সমাজ, আজ সেই আবেগ স্তিমিত। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, আবুল বাশারের উপন্যাস যে গৃহে পৌঁছয়নি, সেখানে সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছে গেছেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী দেলওয়ার সাইদি। দুপুর উজাড় করে তাঁর বক্তৃতার ক্যাসেট শুনছেন মুসলমান সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। কোথাও কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কিন্তু মোটের উপর, উদারপন্থার চর্চা ও সংস্কৃতি চর্চা প্রায় নিঃশেষিত।
বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে কীর্ণাহার, নিমড়ার নাম উঠে এসেছে। কীর্ণাহার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোগী দেবনাথ দাসের জন্মভূমি। তাঁর নামে রাস্তা রয়েছে কীর্ণাহারে। নিমড়া স্বদেশি আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল চল্লিশের দশকে। বিদেশি দ্রব্য বর্জন করে স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহার করতে হবে। অতএব, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁত। সেই তাঁতঘর ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। পরে বন্যায় ধ্বংস হয়ে যায়। কীর্ণাহারের পশ্চিম প্রান্তের গ্রাম সরডাঙ্গা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা আবদুল হালিমের জন্মস্থান। বয়স্কদের কাছে গল্প শোনা যায়, কীর্ণাহারে স্বাধীনতা সংগ্রামী দেবনাথ দাসের সংবর্ধনার অনুষ্ঠানে নিমড়ার বহু ছেলেমেয়ে গান ও কবিতায় অংশ নিয়েছিল। এখন দু’হাজার চোদ্দোতে অবশ্য সে সব গল্পের মতো শোনায়।
সন্ত্রাসের এই জাল এক দিনে বিস্তৃত হয়নি। উদারপন্থী মানুষজন মৌলবাদের রক্তচক্ষু দেখেছেন বিগত আট-দশ বছর। বর্ধমান কাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর নতুন করে ভাবতে হবে কী ভাবে আমাদের যৌথ সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যায়, শান্তির বাতাবরণ তৈরি করা যায়। সে কাজে উদারবাদী হিন্দু-মুসলমান সবাইকে হাত লাগাতে হবে। মুসলিম গ্রামগুলিতে ধর্মচর্চা যত বেড়েছে, সাংস্কৃতিক চর্চা এক্কেবারে কমে গেছে। এলাকার শিক্ষিত ও নিরীহ মানুষ আশির দশক থেকে সমানে রাজনৈতিক হিংসার শিকার হয়েছেন। পরে মৌলবাদী রক্তচক্ষু দেখতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামগুলির একটা বড় অংশে মোল্লাতন্ত্র বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য কোনও মনীষীর জন্মদিন পালন করা যাবে না। এগুলি নাকি ধর্মবিরোধী কাজ।
আমাদের প্রস্তাব, পঞ্চায়েত স্তর থেকে উদ্যোগ নিয়ে আগামী বত্সর থেকে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তের জন্মদিন পালিত হোক। যেখানে কবিতা, গান, নাটক সব কিছু থাকবে। নাটকের দল দু’তিন মাসে দরিদ্র অশিক্ষিত মুসলিম গ্রামগুলিতে গড়ে ওঠা অসম্ভব। তবু সময়সুযোগ মতো সেখানে নাটকের আয়োজন করা যাক। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি শহর ও মফস্সলে নাটকের দল আছে। তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে গ্রামে আনা যেতে পারে।
খারিজি মাদ্রাসার কি কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে? একটা সময় গরিব মুসলমান ছাত্রছাত্রীর খাওয়াপরা এখান থেকে হত। গ্রামের মানুষই সেই দায়িত্ব নিতেন। এখন পশ্চিমবঙ্গের এমন কোনও জনপদ নেই যেখানে হাইস্কুল নেই। সর্বোপরি প্রতিটি স্কুলে মিড-ডে মিল চালু হয়েছে। স্কুলে গিয়ে খাওয়ার ভাবনা এখন তো আর নেই। আর ধর্মশিক্ষা? ধর্মশিক্ষার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান তো নিজের বাড়ি। মা-বাবা, প্রতিবেশী। আর মুসলমান সমাজের ধর্মশিক্ষার জন্য যদি মাদ্রাসা খুলতে হয়, তা হলে ধর্মনিরপেক্ষ এই দেশে হিন্দু সমাজের ধর্মশিক্ষার জন্যও তো সরকারি উদ্যোগে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। যে কয়টি খারিজি মাদ্রাসা এখনও পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে, সেখানে সহানুভূতিশীল নজরদারির ব্যবস্থা থাক। শাসক বা বিরোধী যদি এখনও উদাসীন থাকেন, শুধুমাত্র ভোটের জন্য, তা হলে মৌলবাদ ভিন্ন পথ ধরে তার ডানা মেলবে। সবার উপরে দেশের স্বার্থ। দেশের স্বার্থের ঊর্ধ্বে ভোট-ব্যাঙ্কের রাজনীতি নয়।
জেহাদ নিয়ে নানান তর্কবিতর্ক হয়। অথচ পবিত্র কোরানে কোথাও নরহত্যার দ্বারা জেহাদের কথা বলা হয়নি। বরং তা পুরোটা দেশকে রক্ষার জন্য। হজরত মহম্মদের সময় দেশরক্ষার সেই কাজে হাত লাগাতেন খ্রিস্টান মুসলমান ইহুদি সকলে। জেহাদ আরও কী কী ভাবে সম্পন্ন করা যায়, মহম্মদ তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বললেন, আমি জেহাদে যেতে চাই। মুহম্মদ বললেন, বাড়িতে তোমার মা আছেন, তুমি তাঁর সেবা করো। মায়ের সেবা তোমার জন্য জেহাদ। জেহাদের আর একটি দিক আত্মসংযম। নিজেকে শুদ্ধ করে তোলা। মানবসেবায় বিলীন হয়ে যাওয়া। তালিবানপন্থীরা জেহাদের যে ব্যাখ্যা দেন, তা অপব্যাখ্যা মাত্র।
বাঙালি মুসলমানের কাছে দেশজ ও পশ্চিম এশিয়ার সংস্কৃতি দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্য তথা আরবভূমির সঙ্গে অজস্র ধর্মীয় অনুষঙ্গ, গল্পকথা জড়িয়ে আছে। পয়গম্বরদের অধিকাংশের বাসভূমিই ওখানে। কিশোর বয়স থেকে মুসলমান কিশোর-কিশোরী পরিবার ও সমাজ থেকে সে-সব গল্প, জীবনী শুনে এক মানসিক নৈকট্য অনুভব করেন আরবভূমির সঙ্গে। এই নৈকট্যে অসুবিধা নেই। একই ভাবে দেশজ পুরাণ, লোককথা, দেশীয় নদনদী, সমুদ্র ও অরণ্যভূমিকে আপন করে নেওয়ার শিক্ষা পরিবার থেকে আরও বেশি করে দেওয়া হোক। এ ভাবেই এক গভীর দেশপ্রেম জেগে উঠবে।
দেশ শুধু মানচিত্র নয়। দেশকে ব্যক্তি নির্মাণ করেন প্রতি দণ্ডে, পলে। তাকে বুকের গভীর ঠাঁই দিতে হয়। বাঙালি মুসলমান সমাজের ক্ষুদ্র বিপথগামী অংশটি ও মৌলবাদীরা যত দ্রুত এ কথা বুঝবেন, ততই মঙ্গল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy