Advertisement
১১ মে ২০২৪
সম্পাদকীয়২

সন্দেহের অবকাশ

মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবসে নির্মল মাজি তাঁহার বার্তায় ‘পুণ্যদিবস’ (অসপিশাস ডে) লিখিতে গিয়া ‘সন্দেহজনক দিবস’ (সাসপিশাস ডে) লিখিয়া ফেলিয়াছেন। ইহাতে কৌতুক বোধ হওয়াই স্বাভাবিক। একের ভ্রান্তি বরাবরই অপরের পরিহাসের বিষয় হয়।

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:১৮
Share: Save:

মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা দিবসে নির্মল মাজি তাঁহার বার্তায় ‘পুণ্যদিবস’ (অসপিশাস ডে) লিখিতে গিয়া ‘সন্দেহজনক দিবস’ (সাসপিশাস ডে) লিখিয়া ফেলিয়াছেন। ইহাতে কৌতুক বোধ হওয়াই স্বাভাবিক। একের ভ্রান্তি বরাবরই অপরের পরিহাসের বিষয় হয়। কিন্তু ইহা কেবল নির্মল হাস্যরসের বিষয় নহে। বরং বহু দিনের কিছু সন্দেহ এই ভুলের সুযোগে মাথা চাড়া দিয়া উঠিল। সে সব সন্দেহের কোনওটা অবশ্য ব্যক্তি নির্মল মাজিকে লইয়া নহে। সরকারি হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিস করাইবার আদেশ হইতে পরীক্ষায় কারচুপির সহায়তা, এমন নানা অভিযোগে বার বার নির্মলবাবুর নাম জড়াইয়াছে। সেই সব অভিযোগ ও তাহার যে প্রতিক্রিয়া মিলিয়াছে, তাহাতে নির্মলবাবুর কাণ্ডজ্ঞান লইয়া সন্দেহের কোনও অবকাশ নাই। প্রশ্ন মেডি়ক্যাল কলেজের চিকিৎসক, তথা গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থার মনোভাব লইয়া।

কলকাতার মেডিক্যাল কলেজটি এশিয়ার প্রাচীনতম মেডিক্যাল কলেজ। ইহার ঐতিহ্য অসামান্য, খ্যাতি আন্তর্জাতিক। এখনও প্রবেশিকা পরীক্ষায় নির্বাচিত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যাঁহারা সেরা, তাঁহারাই মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ পাইয়া থাকেন। কলেজের প্রাক্তনী সংগঠনের সদস্য চিকিৎসকরা অনেকে বৃহত্তর জনজীবনেও নানা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অথচ সেই মেডিক্যাল কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন চিকিৎসক-শিক্ষকরা ভ্রান্তিপূর্ণ, অতি-দীর্ঘ, এবং সরকার-আনুগত্যে চিটচিটে একটি শুভেচ্ছাবার্তা বিনা আপত্তিতে স্মরণিকায় ছাপাইয়া দিলেন। ইহা বিস্ময়কর। নির্মলবাবুর ভ্রান্তিগুলি হাস্যকর, কিন্তু তাহা সংশোধন করিবার দায় যে শিক্ষক-চিকিৎসকরা অস্বীকার করিলেন, তাহা হাসির উদ্রেক করে না। বরং এক প্রকার গ্লানির জন্ম দেয়। শিক্ষা যদি মানুষকে সত্য বলিবার সাহস না দেয়, ভ্রান্তি শুধরাইবার ক্ষমতা না দেয়, তবে তাহার উপযোগিতা কী? নিজ পেশায় সফল, প্রতিষ্ঠিত মানুষেরাও সামান্য নেতার সামান্য ভুল এত সহজে মানিয়া লইবেন কেন?

চিকিৎসকরা রাগ করিয়া বলিতে পারেন, ইহা তিলকে তাল করিবার অপচেষ্টা। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকাইলে বোঝা যায়, সমাজের অন্যমনস্কতা, আত্মনিমগ্নতার সুযোগে জাতির জীবনে মস্ত বিপর্যয় ঘটিয়া যায়। ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ স্মরণীয়। ইংরাজের আক্রমণের মতো গুরুতর বিষয়ও দুই ক্রীড়ামগ্ন রাজপুরুষের চিত্তপটে চাঞ্চল্য তৈরি করে না। এই অকল্পনীয় ঔদাসীন্য তাঁহাদের দীর্ঘদিনের কর্তব্যবিমুখতার পরিণাম। বিচার-বিতর্কের অভ্যাস হইতেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ জন্ম নেয়। অকস্মাৎ উদয় হয় না। সামান্য ব্যাপারেও যাঁহারা ঘাড় কাত করেন, কঠিন বিষয়ে তাঁহারা রুখিয়া দাঁড়াইবেন, এমন প্রত্যাশা করা যায় না। তাই উদ্বেগ জাগে, স্বাস্থ্য পরিবেষার নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নিলেও কি আমাদের চিকিৎসকরা তাহা ঘাড় কাত করিয়া মানিয়া লইবেন? হয়তো ইহা কেবল সম্ভাবনা নহে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক নিয়োগ, কলেজে ছাত্রভর্তি হইতে নূতন হাসপাতাল নির্মাণ, এমন অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাইতেছে, বিশেষজ্ঞরা ক্ষমতাসীনের ভ্রান্ত নীতিকে নীরবে উপেক্ষা করিতেছেন, অথবা সাগ্রহে অনুবর্তন করিতেছেন। ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষা করিবার এই ব্যগ্রতা সমাজ ও জাতির জীবনে বৃহৎ সংকট তৈরি করিতেছে। মেডিক্যাল কলেজের স্মরণিকায় লজ্জাজনক ভুল তাহার সঙ্কেত মাত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE