Advertisement
১১ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

সভ্যতার সংকট

জ ল শুধু জল। বর্ষণমুখরিত বঙ্গদেশে চতুর্দিকে জল। এই বিপুল বারিরাশি প্লাবনের ফল নহে, জলনিকাশের সুব্যবস্থা না থাকায় জল জমিয়াছে। বেসিন-সদৃশ কলিকাতা তো জন্ম হইতেই জলাঞ্জলিপ্রদত্ত, এমনকী রাঢ়বঙ্গের লালমাটির জেলাগুলিতেও জল জমিয়াছে। সিউড়ি শান্তিনিকেতনে জমা ঘোলা জল, ভুবনডাঙা ভাসিতেছে। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা জলের দাপটে বিচলিত।

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

জ ল শুধু জল। বর্ষণমুখরিত বঙ্গদেশে চতুর্দিকে জল। এই বিপুল বারিরাশি প্লাবনের ফল নহে, জলনিকাশের সুব্যবস্থা না থাকায় জল জমিয়াছে। বেসিন-সদৃশ কলিকাতা তো জন্ম হইতেই জলাঞ্জলিপ্রদত্ত, এমনকী রাঢ়বঙ্গের লালমাটির জেলাগুলিতেও জল জমিয়াছে। সিউড়ি শান্তিনিকেতনে জমা ঘোলা জল, ভুবনডাঙা ভাসিতেছে। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা জলের দাপটে বিচলিত। প্রতি বছরই তাঁহারা এমন ভাবে বিচলিত হন এবং তাহার পরে জল নামিয়া গেলে আবার সে সকল ভুলিয়া যান। ব্যাধিটি নূতন নহে। ব্যাধি অতি পুরাতন। রোগ এক দিনের নয়, অনেক দিন ধরিয়া তাহা জমিয়াছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার দিনলিপি ‘স্মৃতির রেখা’তে একস্থানে লিখিয়াছিলেন, এখন যেখানে মহানগরী, আজ হইতে কয়েক শত বৎসর পরে সেই স্থান দিয়া জলধারা প্রবাহিত হইবে। প্রকৃতিদর্শী বিভূতিভূষণ বুঝিয়াছিলেন, সভ্যতা প্রকৃতির সহিত বৈরী সম্পর্ক স্থাপন করিয়াছে। প্রকৃতিকে পদানত করিয়া জয়ধ্বজা উড়াইবার স্বপ্ন নবজাগ্রত মানব একদা দেখিত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অহংকারে প্রকৃতিকে জয় করিবার বাসনা।

সমস্যার মূল এই বাসনাতেই। প্রকৃতি বিপুল ও বৃহৎ। মানব সেই প্রকৃতিরই অংশ। এই বোধ থাকিলে মানুষ প্রকৃতিকে জয় করিতে চাহিত না, প্রকৃতির সহিত সহবাস করিতে চাহিত। প্রকৃতির সহিত সহবাসের অর্থ এ ক্ষেত্রে আদিম মানুষের ন্যায় অসহায় দশায় প্রকৃতির হাতের পুতুল হইয়া থাকা নহে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে প্রকৃতির অনুকূলে প্রয়োগ করিয়া সহবাস করিতে হইবে। এই যে বর্ষণের ফলে জল জমিতেছে, ইহার কারণ নগর পরিকল্পনার অভাব। নগরে যত্রতত্র নির্মাণ হইতেছে। সুবিশাল আকাশচুম্বী ইমারত, বাণিজ্যবিপণি, আবাসস্থল। দেখিয়া মনে হইবে আহা, বিজ্ঞানের কী মহিমা। মাটিতে পদস্পর্শ করিলেই টের পাওয়া যাইবে মহিমা জলকাদালাঞ্ছিত। কোথাও হাঁটু অবধি, কোথাও তাহার চাহিতেও বেশি। যানবাহন অচল। কর্মনাশা দিন।

উপায় কী? প্রথমেই স্বীকার করিতে হইবে দোষ বৃষ্টির নহে, জলেরও নহে দোষ আমাদের। বর্ষাকালে বৃষ্টি হইবেই। জলকে চলাচলের পথ না দিলে জল তো জমিবেই। প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব চরিত্র আছে। বিশ শতকের নগর পরিকল্পক প্যাট্রিক গেডেস বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়াছিলেন। অঞ্চলের চরিত্র বুঝিয়া নগর পরিকল্পনা করিতে হয়। যে হর্ম্য আমেরিকায় দেখিতে ভাল সেইরূপ হর্ম্য কলিকাতার বক্ষে বানাইলে সেই অঞ্চলের প্রকৃতি কোথাও বিনষ্ট হইবে কি না তাহা বুঝিতে হইবে। আঞ্চলিক ভূমির প্রকৃতি, বর্ষাকালে জলধারা প্রবাহিত হইবার গতি, ভূভাগের ঢাল ইত্যাদি বিচার করিয়া নির্মাণ করিতে হয়। আবার দেখিতে হয়, যাহা নির্মাণ করিলাম তাহা সুরক্ষিত, কিন্তু পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠী ও পরিবেশের উপর তাহার প্রভাব কী। মাথাটি তুলিয়া বাড়িটি আকাশ স্পর্শ করিল বটে, কিন্তু তাহার বিরাজমানতার ফলে এ পাশ হইতে ও পাশে জল যাইবার উপায় গেল বন্ধ হইয়া। ফলে বর্ষাকালে হর্ম্যবাসীগণ আকাশের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিলেন আর নীচের মানুষ জলে ডুবিয়া অহোরাত্র তাঁহাদের শাপশাপান্ত করিতে লাগিলেন। সামাজিক ও প্রাকৃতিক উভয় পরিবেশের পক্ষেই এই অবস্থা ক্ষতিকর। যাহা হইয়াছে তাহা তো সব ধূলিসাৎ করা যাইবে না। অবাঞ্ছিত নির্মাণ বিষয়ে সচেতন হইতে হইবে সকলকেই। নগর ভাসিলে শেষ অবধি আপনার বাড়িটিও বাঁচিবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE