বাংলাদেশে ছাত্রছাত্রীরা উন্নাসিক নন
ব্লগার-লেখক অভিজিৎ রায়কে যে দিন হত্যা করা হল, সে দিন থেকেই মনের মধ্যে একটা সুপ্ত বাসনা ছিল বাংলাদেশের পরিস্থিতিটা যে আসলে কী, এক বার স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে আসব। রওনা হলাম ২ নভেম্বর সকালে।
তার দুদিন আগে থেকেই আমি আমার ব্যাগ গোছাতে শুরু করেছি। মনে মনে একটা প্ল্যানও করেছি। কোথায় কোথায় যাব। কার কার সঙ্গে দেখা করব। তালিকার উপরেই ছিল প্রখ্যাত ভাস্কর শামিম শিকদার ও অধ্যাপক অজয় রায়ের নাম। আর অবশ্যই শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু যাওয়ার আগের দিনেই পেলাম সেই মর্মান্তিক সংবাদটা। অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক ফয়সল আরেফিন (দীপন)-কে মৌলবাদীরা খুন করেছে। একই সঙ্গে জখম করেছে প্রকাশক আহমেদ রশীদ চৌধুরী (টুটুল)। কবি তারেক রহিম ও লেখক রণদীপম বসু। এঁদের আক্রমণের কারণ, এঁরা মুক্তমনা ও সাহসী। এঁরা মনে করেন, কোনও ব্যক্তি বা গ্রন্থ বা কোনও প্রথা, তাদের যত পবিত্রই বলা হোক না কেন, তা যত লোকই মেনে চলুক না কেন, কেউই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। অর্থাৎ ব্যক্তিমানুষ আমরা যত ক্ষুদ্রই হই না কেন, আমাদের প্রত্যেকেরই অধিকার আছে সমস্ত কিছুকে সমালোচনা করার।
যা-ই হোক, এগারোটা নাগাদ ঢাকা পৌঁছলাম। ইমিগ্রেশন পর্ব চুকিয়ে বাইরে এসে সোজা ঢাকা ইউনিভারসিটি যাওয়ার জন্য অটো নিলাম। এমনিতেই ঢাকার রাস্তায় জ্যাম হয়। তার ওপর সে দিন ছিল মুখ্যমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিটিং। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সোহরাওয়ার্দী ময়দানে জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে মিটিং। কাতারে কাতারে লোক আসছে। গরিব লোকের সংখ্যাই বেশি। মেয়েদের সংখ্যা বেশ কম। কিছু দূর গিয়ে অটো আর যেতে পারল না। মিছিলের সঙ্গে হাঁটা শুরু করলাম।
এই মিটিংটা আমার সামনে একটা মিনি বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরল। গরিব কিন্তু প্রত্যয়ী। তিনটে নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি (এটি ছাত্র ও শিক্ষকদের মিলন স্থল)-তে পৌঁছলাম। এক ঝাঁক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা হল। এদের বেশির ভাগেরই বই পড়ার অভ্যাস আছে। এরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। বেশির ভাগেরই মনে একটি মুক্তচিন্তার পরিসর আছে। আর এদের অনেকের কাছে ইউরোপ ও আমেরিকা যাওয়ার হাতছানি আছে। প্রচুর ছেলেমেয়ে পড়াশোনার ফাঁকে এনজিও-র সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছে।
কথা হল মানজুরা, মোহানা আফ্রোজা ও আবদুল্লাদের সঙ্গে। এদের সবারই অভিমত, বাংলাদেশে মৌলবাদীরা সক্রিয়। তবে এরা পরাস্ত হবেই। তার কারণ, রবীন্দ্র নজরুলের প্রভাব যেমন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অটুট, তেমনই ইউরোপ আমেরিকার একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলাদেশের লোকেদের জীবনে পড়তে শুরু করেছে। আর একটি জিনিস বুঝলাম, আজও যে কোনও বড় আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এরা এখনও এ পার বাংলার ছাত্রছাত্রীদের মতো উন্নাসিক হয়ে যায়নি।
সন্ধেবেলায় লেখক প্রকাশকদের ধারাবাহিক ভাবে হত্যার প্রতিবাদে মুক্তমনারা শাহবাগে একটি মশাল মিছিল বের করল। তাদের সঙ্গে আমিও পা মেলালাম। মিছিলে পড়াশোনায় ভাল ছাত্রছাত্রীদেরই ভিড় বেশি। সেখান থেকে পরদিন ছয় ঘণ্টার হরতালের ডাক দেওয়া হল। যদিও সেই হরতালের প্রভাব স্কুলকলেজ ছাড়া কোথাও পড়েনি। বাংলাদেশের মানুষজন আর হরতাল চাইছে না। তবে তারা চাইছে এই হত্যালীলা বন্ধ হোক।
দীপনের স্ত্রীকে দেখলাম। কথা বলতে পারলাম না। দূর থেকে নমস্কার জানালাম। বাংলাদেশের অনেকেই এই হত্যার পিছনে কে, তা নিয়ে সন্দিহান। তবে সকলেই একবাক্যে স্বীকার করছে যে সরকার কঠোর অবস্থান নিলে এই সব হাঙ্গামা বন্ধ করা সম্ভব।
পরের দিন নজরুলের সমাধিতে গেলাম। বেশ ভাল লাগল। অনেক সম্মানের সঙ্গেই নজরুল ওখানে সমাহিত। এ পারে এটা একদমই সম্ভব হত না। এইখানে রবীন্দ্রনাথের সমাধি মন্দিরই অযত্নে পড়ে আছে।
যাক, আমি কিন্তু এক রাশ আশা নিয়েই ভারতে ফেরত এসেছি। বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার প্রচারকরা এখন এক ভয়ের পরিবেশের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তবুও আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশে মৌলবাদীদরা পরাস্ত হবেই। সমাজজীবনে গোঁড়ারা এখনই অপাঙ্ক্তেয়। ভবিষ্যতে এরা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়বে। তার অন্যতম কারণ, বাংলাদেশের সংস্কৃতি মূলত সেকুলার সংস্কৃতি।
ওসমান মল্লিক। কলকাতা-২
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy