ভা রতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করিল— অবশ্য, ইহাকে মহা-বিশ্বরেকর্ড বলিলেও দোষ নাই, রেকর্ডের কার্যক্ষেত্রটি সমুদ্রতল হইতে প্রায় ৩৬,০০০ কিলোমিটার ঊর্ধ্বে। ইসরো তাহার সি৩৭ মিশনে এক দফায় মোট ১০৪টি কৃত্রিম উপগ্রহকে জিওস্টেশনারি ট্রান্সফার অরবিট-কে স্থাপন করিয়াছে। আগের বিশ্বরেকর্ডটি ছিল রাশিয়ার, ২০১৪ সালে তাহারা এক দফায় মোট ৩৭টি কৃত্রিম উপগ্রহ বহন করিয়াছিল। চন্দ্রযান, মঙ্গলযানের সাফল্যের পর বর্তমান কৃতিত্বটি ইসরো-কে গোটা দুনিয়ার চোখেই সম্ভ্রমজনক করিয়া তুলিয়াছে। অবশ্য, যাহা প্রযুক্তির উদ্যাপন হওয়া বিধেয় ছিল, ভারতে তাহাই উগ্র জাতীয়তাবাদের স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছে। মঙ্গলযানের সাফল্যের পরেও যাহা হইয়াছিল, সি৩৭-এর সাফল্যও তাহারই সাক্ষী থাকিল। ইসরো-এর এই সাফল্য যে চিন এবং উন্নত দুনিয়াকে ভারতের টেক্কা দেওয়া, ইহাই মূল সুর হইয়াছে। এবং, কাজটি ভারত কতখানি কম খরচে করিয়াছে, তাহাও সেই ধারাবিবরণীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হইয়াছে।
ভারতীয়রা যেমন বিশ্বরেকর্ড-প্রিয়, তেমনই ‘সস্তায় পুষ্টিকর’-এর খোঁজও ভারতীয় চরিত্রের অভিজ্ঞান। কাজেই, ইসরো অতি কম খরচে মহাকাশযান প্রেরণ করিতেছে, ইহা ভারতীয়দের নিকট অতি তাৎপর্যপূর্ণ একটি সংবাদ। সমস্যা হইল, গৃহস্থালি যে নিয়মে চলে, মহাকাশ প্রযুক্তি সেই নিয়ম মান্য করে না। প্রযুক্তিচর্চার মূল মন্ত্র হইল ক্রমাগত ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়া। বিশেষত, কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণের ক্ষেত্রটি অধুনা বহুলাংশে বাণিজ্যিক। ইসরো-র সি৩৭-ও যত উপগ্রহ লইয়া গিয়াছে, তাহার অধিকাংশই বাণিজ্যিক সংস্থার। সংস্থাটির ব্যয়শৌণ্ডিকতার মূলে রহিয়াছে পিএসএলভি মহাকাশযান। তুলনায় কম শক্তিসম্পন্ন, ফলে তাহার খরচও কম। কিন্তু, এই গোত্রের মহাকাশযানের বহনক্ষমতাও সীমিত। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে যখন চাহিদা অন্তত সাড়ে তিন হাজার কিলোগ্রাম ভারবাহী মহাকাশযানের, সেখানে ইসরো-র পিএসএলভি-র বহনক্ষমতা তাহার তিন ভাগের এক ভাগ। ইসরো-র পক্ষেও সেই সাড়ে তিন হাজার কিলোগ্রামের দৌড়ে যোগ দেওয়া সম্ভব— তাহার ভাঁড়ারেও জিএসএলভি মহাকাশযান আছে। কিন্তু, তাহা ব্যয়বহুল। ফলে, ব্যয়শৌণ্ডিকতাকে ক্রমাগত মহিমান্বিত করিবার অর্থ, ইসরো-কে ভবিষ্যৎমুখী হইয়া উঠিতে বাধা দেওয়া। আন্তর্জাতিক প্রযুক্তির লড়াইয়ে তাহার ফল ভাল হইবে না। চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যমে ইসরো-প্রশস্তির মধ্যেও এই বিপদের ছায়া লুকাইয়া আছে। দীর্ঘমেয়াদে মহাকাশ-বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিতে হইলে এখন বিনিয়োগ করিতে হইবে বইকী।
ইসরো সরকারি সংস্থা, ইহা জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারীদের নিকট যতখানি সুসংবাদ, সংস্থাটির নিকট ঠিক ততখানি নহে। সংস্থাটি বেসরকারি হইলে বাণিজ্যিক নিয়মই তাহার চালিকাশক্তি হইত। কিন্তু, ইসরো-র রাশ সরকারের হাতে। ফলে, সংস্থাটি কোন প্রকল্পকে গুরুত্ব দিবে, আর কোন খাতে কত খরচ করা হইবে, তাহা শেষ অবধি স্থির হইবে সরকারি টেবিলে। সেই প্রক্রিয়ার ভাল-মন্দ ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু এক্ষণে স্মরণে রাখা বিধেয় যে স্পেসএক্স-এর ন্যায় বেসরকারি সংস্থার সহিত ইসরো-র তুলনা করিলে তাহা ভারতীয় মহাকাশ সংস্থার প্রতি অবিচার হইবে। সরকারের বাঁধিয়া দেওয়া সীমায় তাহার সাফল্য প্রশ্নাতীত। সরকার তাহার সীমাটিকে প্রসারিত করিবে কি না, তাহাই প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy